পার্বত্য চট্টগ্রামের উখিয়া-টেকনাফ বনাঞ্চলের হাতিরা খাবার ও পানির তীব্র সংকটের ফলে কী গুরুতর দুর্দশায় পড়েছে, তার কিছু তথ্য পাওয়া গেল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সচিত্র প্রতিবেদনে। ছবিতে দেখা গেল জঙ্গলের এক জায়গায় কয়েকটি হাতির করুণ অবস্থা—শুকিয়ে হাড্ডিসার। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে সুস্থ বন্য হাতিদের চেহারা সাধারণত এতটা শীর্ণ হয় না। দেশের পার্বত্যাঞ্চলে হাতিদের নিরুপদ্রবে বসবাস ও চলাচলের জায়গাগুলো ভয়ানক সংকুচিত হয়ে এসেছে; তাদের খাবার ও পানির সংকট সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ এটাই।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও লোকালয়ের ক্রমবিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বনজঙ্গলগুলো উজাড় হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় ও অরণ্যের মিশ্রণে অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও বিপুল প্রাণবৈচিত্র্য পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এমন প্রাকৃতিক সমৃদ্ধি বাংলাদেশের আর কোনো অঞ্চলেই নেই। এই বিরল সমৃদ্ধির মূল্য আমরা কখনোই যথাযথভাবে উপলব্ধি করিনি। তাই সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক ও প্রতিবেশগত ঝুঁকির বিষয়গুলো বিবেচনা না করেই ওই অঞ্চলে একসময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বসতি স্থাপনকে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে ওই বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অঞ্চলের ঐতিহ্যগত জনমিতিক ভারসাম্য ভীষণভাবে ওলটপালট হয়ে গেছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চেয়ে বড় হয়েছে বসতি স্থাপনকারীদের আকার, যারা পাহাড়-অরণ্যের মর্ম বোঝে না, জানে না ওই পরিবেশে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে কীভাবে জীবনযাপন ও জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। অবিরাম চলেছে পাহাড় কাটা ও বনজঙ্গল উজাড় করার আত্মবিনাশী তৎপরতা।
বহু বছর ধরে চলমান এসব কাণ্ডের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ইতিমধ্যেই বেশ বিপন্ন। সর্বশেষ যে ক্ষতিটা যুক্ত হয়েছে, তা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দান ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাবের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা ও বিবেচনাবোধের অভাবের ফল। তাদের পুনর্বাসন করতে গিয়ে পাহাড় কেটে সমতল করা হয়েছে; প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের ভেতরে গাছপালা ধ্বংস করে গড়ে তোলা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির। ৬ হাজার ১৬২ একর এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা শরণার্থী শিবির হাতিসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক বসবাস ও চলাচলের পথে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এশীয় বন্য হাতি বাংলাদেশে ইতিমধ্যে এক মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে আইইউসিএন কর্তৃক চিহ্নিত হয়েছে। উখিয়া-টেকনাফের বনাঞ্চলে বন্য হাতির সংখ্যা এখন হাতে গোনা যায়—মোট ৬৭টি হাতি সেখানে অবশিষ্ট আছে। খাবার ও পানির সংকটে তাদের অবস্থাও এখন বিপর্যয়কর। এসব ক্ষুধার্ত হাতি খাদ্যের সন্ধানে মরিয়া হয়ে কখনো কখনো লোকালয়ে হামলা চালাচ্ছে। চূড়ান্ত বিপর্যয় ও বিলুপ্তি থেকে এদের রক্ষা করতে হলে এখনই তৎপর হতে হবে। প্রথমত তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে; তারা খাবার ও পানির সন্ধানে যেসব পথ দিয়ে নিয়মিতভাবে চলাচল করে, সেগুলোকে মানুষের উপদ্রব থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি।