মাদকের মামলা

বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা দিয়েছিল, মাদকের বিরুদ্ধে তারা শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাবে। এরপর মাদকবিরোধী অভিযানে বহু অভিযুক্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও দেশে মাদকের বিস্তার রোধ করা যায়নি; বরং মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এক পরিসংখ্যানমতে, বাংলাদেশে ৭৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত, যঁাদের ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত।

এ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ মাদকের উৎস বের করতে না পারা। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত তিন বছরে (২০১৯ থেকে ২০২১) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ১৭টি থানায় দায়ের করা ৫৩টি মামলা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২টি—মোট ৫৫ মামলার এজাহার ও আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে দেখা যায়, মাদক উদ্ধারের ঘটনায় ধরা পড়েন শুধু এর বাহকেরা। তদন্তেও নতুন তথ্য উঠে আসে না। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন মাদক কারবারের মূল হোতা, অর্থের জোগানদাতা ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকেরা।

আইনানুযায়ী মাদক কেনাবেচায় অর্থ সরবরাহকারী, বিনিয়োগকারী, পৃষ্ঠপোষক, মদদদাতা, সহায়তাকারী ও প্ররোচনাকারী—এ ছয় ধরনের অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু অপরাধীরা যদি ধরাই না পড়েন, আইন করে কোনো লাভ হবে না।

উদ্বেগের বিষয় হলো তদন্ত কর্মকর্তারা মাদক ব্যবসার বাহকদের রিমান্ডে নিয়েও নেপথ্যের ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে পারছেন না। অনেক সময় তদন্তকারী কর্মকর্তারা কল্পিত মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে মোটা অঙ্কের উৎকোচ আদায় করেন বলে অভিযোগ আছে। ডিএমপি কমিশনার স্বীকার করেছেন, এখন মাদক ব্যবসা চলে ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে। তাই মামলার তদন্তে মাদকের উৎস, মূল হোতা ও অর্থের জোগানদাতাদের তথ্য পাওয়া যায় না।

মামলাগুলোর অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, এসব মামলায় নতুন করে কোনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেননি তদন্তকারী কর্মকর্তারা। পরে কোনো মাদকদ্রব্যও উদ্ধার হয়নি। সমস্যাটি কেবল ডিএমপি এলাকার নয়, সারা দেশের। মাদক ব্যবসায়ীরা এতটাই বেপরোয়া যে গত এপ্রিল মাসে কুমিল্লার স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদকের আস্তানার খোঁজে গেলে তাঁরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন।

মাদকের ভয়াল থাবায় অসংখ্য মানুষের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। সমাজবিজ্ঞানীরা একে ক্যানসারের চেয়েও ভয়ংকর ব্যাধি বলে অভিহিত করেছেন। সরকার যদি সত্যি সত্যি মাদকমুক্ত সমাজ তৈরি করতে চায়, তাহলে এর উৎস খুঁজে বের করতে হবে। সীমান্তপথে মাদক আসা বন্ধ করতে হবে। যেখানে সীমান্তে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী আছে, সেখানে মাদক দেশের ভেতরে ঢোকে কীভাবে?

তাই আমরা মনে করি, মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে হলে কেবল কঠোর আইন করলেই হবে না; সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মাদক ব্যবসার নেপথ্যের হোতাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে।

দীর্ঘদিন মামলা ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মামলা চলেছে। এতে মাদক ব্যবসায়ীরা আশকারা পেয়ে যান। মনে রাখতে হবে, মাদক সেবন ও ব্যবসা এমন একটি অপরাধ, যা কেবল আইন দিয়ে দমন করা যাবে না; এর জন্য সামাজিক জাগরণও সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো হতে বাধ্য।