শিক্ষাকে আমরা বহন করে চলেছি, বাহন করতে পারিনি—রবীন্দ্রনাথের এ আক্ষেপের পর এ দেশে উচ্চশিক্ষা বহু গুণ বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীর ওপর কোনো কোনো শিক্ষকের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায্য অনুশাসনের বোঝা লাঘব হয়নি। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাসন-সাজার চাপ যত বেশি, তা তত উঁচু দরের প্রতিষ্ঠান—এমন একটি ধারণা বহু যত্নে লালিত হয়ে আসছে। মহা ক্ষতিকর এই সামাজিক প্রবণতার কারণে মাঝেমধ্যেই শিক্ষার্থীদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ছয় শিক্ষার্থীকে এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। শ্রেণিকক্ষ অপরিচ্ছন্ন থাকা নিয়ে তিন–চার মাস আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করার কারণ দেখিয়ে তাঁদের গত বুধবার বহিষ্কার করা হয়েছে। নিজ শ্রেণিকক্ষের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে তির্যক মন্তব্য আদৌ অপরাধ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাপরিপন্থী কাজের পর্যায়ভুক্ত কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। এটি ‘অপরাধ’ বিবেচিত হলেও তা লঘু অপরাধ। কিন্তু তার জন্য বহিষ্কারাদেশ দেওয়াকে নিঃসন্দেহে গুরুদণ্ডে সাব্যস্ত করা যায়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন-চার মাস আগে শ্রেণিকক্ষ অপরিচ্ছন্ন থাকা নিয়ে ফেসবুকে একটি মন্তব্য করেছিলেন ইইই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হাবিবুল্লা নিয়ন। তাতে সায় দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন আরও পাঁচ শিক্ষার্থী। এই এত দিন পরে তাঁদের এসব মন্তব্যকে ‘আপত্তিকর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী’ বলে সাব্যস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরিত নোটিশে তাঁদের ‘একাডেমিক বহিষ্কারের’ কথা জানানো হয়েছে। হাবিবুল্লাকে এক বছর (দুই সেমিস্টার), অন্য পাঁচ শিক্ষার্থীকে ছয় মাসের জন্য (এক সেমিস্টার) বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারের মেয়াদ চলাকালে তাঁরা ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না।
এই শিক্ষার্থীরা ছয় মাস বা এক বছর ক্লাস করতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অনীহা আসতে পারে। একইসঙ্গে শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণাও তৈরি হতে পারে।
আমাদের শিক্ষকদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষকদের মনে রাখা দরকার, পিতামাতার পরই শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের অভিভাবক। সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের ভুল শিক্ষকদের স্নেহের চোখে দেখাই কাম্য।
শ্রেণিকক্ষের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে শিক্ষার্থীরা মন্তব্য করলে তাঁদের ‘সাজা’ না দিয়ে পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ দেওয়াই বিধেয়। এই সহজ সত্যটি না মেনে ‘কিল মারার গোঁসাই’য়ের ভূমিকায় নামলে তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামারই নামান্তর হয়। এটি অসুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সেটি বিবেচনায় নিয়ে এসব শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ দ্রুত প্রত্যাহার করা হোক।