ফাঁকা মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে যে মাল্টিমিডিয়া প্রকল্প নিয়েছিল, তা কার্যত কোনো ফল দেয়নি। অথচ বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে কথিত প্রশিক্ষণ দেওয়া, কেনাকাটা করা এবং প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পকেট ভারী করার কাজে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল চার বছর। এরপর এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়, যার ছয় মাস ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে।

গত রোববার প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরা পড়ায় তদন্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ অধিদপ্তর। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হওয়ার পরও মাল্টিমিডিয়ানির্ভর একটি শ্রেণিকক্ষও তৈরি করা যায়নি। তবে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি, ১ লাখ ৪৪ হাজার ১৫৪ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৪ হাজার ১৫৪ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও চলতি অর্থবছরে কাউকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তদন্তে আরও বেরিয়ে এসেছে, ৪৪৭টি ব্যাচের প্রতিটির জন্য প্রকল্প পরিচালক আবদুস সবুর খান প্রশিক্ষণের নামে একাই হাতিয়ে নিয়েছেন ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ টাকা। সেই সঙ্গে তিনি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের প্রধানদেরও তার ভাগ দিয়েছেন। একেই বলে ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের জন্য স্থান ভাড়া নেওয়া, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় নিয়মবহির্ভূত বিপুল অর্থের অপচয় করা হয়েছে। দরপত্র ছাড়া ৩০ লাখ টাকার বেশি কেনাকাটা করার বিধান না থাকলেও প্রকল্প পরিচালক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব বিভাগকে ‘হাত’ করে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছেন। প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোতে মডেম পাঠানো হয়েছে, ল্যাপটপ পাঠানো হয়নি। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া আরকি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাল্টিমিডিয়া প্রকল্পের এটি ছিল দ্বিতীয় পর্যায়। এর আগে প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথম পর্যায়ের কাজের মূল্যায়ন না করেই দ্বিতীয় পর্যায় চালু করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু এত বড় দুর্নীতির পর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া শাস্তি হতে পারে না। প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা খরচ হওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা যে বঞ্চিত হলো, সেই দায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে।

সরকারের বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্প এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই বেশি লাভবান হন। আর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা প্রশিক্ষণ ও বক্তৃতার নামে কেন টাকা নেবেন? তাঁরা তো কাজের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা পান। প্রযুক্তিবিদ মোহাম্মদ কায়কোবাদ যথার্থই বলেছেন, এত লোকের সরাসরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

কেবল পরিচালক ও তাঁর সহযোগীরা নন, যাঁরা প্রকল্প তদারকের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদেরও জবাবদিহি প্রয়োজন। মাল্টিমিডিয়া প্রকল্পের নামে বহুমুখী দুর্নীতি চলতে দেওয়া যায় না।