বাংলাদেশ একসময় খাদ্যঘাটতির দেশ ছিল; বছরের কয়েকটা মাস উত্তরবঙ্গের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ ‘মঙ্গা’র শিকার হতো। এখন আমরা সেই দুরবস্থা পেছনে ফেলে এসেছি। আজ আর দেশের কোথাও মানুষ অনাহারে মারা যায় না। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। অবশ্য আমাদের এই ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ সীমাবদ্ধ শুধু প্রধান খাদ্য চালের উৎপাদনের ক্ষেত্রে। কৃষির ব্যাপক অগ্রগতির ফলে ধান উৎপাদন এমন ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে যে স্বাধীনতার পরের প্রায় পাঁচ দশকে জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হওয়ার পরও আমাদের ভাতের অভাব দূর হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক উন্নতি ও মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন ভাত ছাড়া অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা ও কেনার ক্ষমতা বাড়ছে, তখন দেখা যাচ্ছে, অনেক খাদ্যই আমাদের দেশের মোট চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদিত হয়। চাহিদা মেটাতে অনেক খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তবে এর সমান্তরালেই আমাদের দেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি পরিমাণে রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কদিন আগে ঢাকায় তিন দিন ধরে অনুষ্ঠিত হলো প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী; সেখানে এ দেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা আগামী দুই বছরের মধ্যে তাদের রপ্তানির পরিমাণ বাড়িয়ে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে চায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে তাদের এই আশা বাস্তবসম্মত বলে আমাদের মনে হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি গত দুই বছরেই বেড়েছে প্রায় ৮১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৭০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। রপ্তানি বৃদ্ধির এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালে ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছানো সম্ভব বলেই আমাদের মনে হয়।
আমরা যেসব প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রুটি, বিস্কুট, চানাচুর, ফলের রস ও অন্যান্য পানীয়, রান্নায় ব্যবহার্য মসলা, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি। এসব খাদ্য রপ্তানি করা হয় প্রধানত ভারত, নেপাল, ভুটান, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে; তবে ইউরোপ-আমেরিকায়ও কিছু পরিমাণে রপ্তানি হয় এবং এর পরিমাণ বাড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব খাদ্যপণ্যের সিংহভাগ ভোক্তা এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষ এবং একটা অংশ ইউরোপ-আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশি ও এশীয় জনগোষ্ঠী। কয়েক ধরনের খাদ্যপণ্যের প্রধান রপ্তানিবাজার হলো ভারত। আমরা যদি ইউরোপীয় ও আমেরিকান ভোক্তাদেরও আকর্ষণ করতে পারি, তাহলে রপ্তানি আয় অনেক বাড়ানো সম্ভব। সে জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আমাদের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের গুণগত মান বাড়িয়ে এমন পর্যায়ে উন্নীত করা, যাতে সেগুলো ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে প্রচলিত অন্যান্য দেশের খাদ্যপণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে।
এটাই আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। আমরা ইউরোপের কিছু দেশে আম, আলু ইত্যাদি কয়েকটি কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে গিয়ে গুণগত মান রক্ষার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি এবং এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। কৃষিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে আমাদের কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে গুণগত মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যও প্রধানত কৃষিজাত, সুতরাং কৃষিক্ষেত্রে বিষাক্ত ও ক্ষতিকর সব ধরনের উপাদানের ব্যবহার কমিয়ে আনা আশু প্রয়োজন। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে গুণগত মান উন্নয়ন ও রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক মানের কারখানা স্থাপন, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, সরবরাহ ইত্যাদি প্রতিটি ধাপেই যথাযথ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু রপ্তানির জন্য নয়, দেশের ভেতরের ভোক্তাদের জন্যও একই গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদন করা প্রয়োজন।