এই নীরব মড়ক থামাতে হবে

পানিতে ডুবে দিনে ৪০ মৃত্যু

রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় শিশু রাখালের মাসি নিতান্ত পরিহাসছলে বলেছিলেন, ‘চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে!’ সাগরে ঝড় ওঠার পর নৌকাডুবির উপক্রম হলো। সবাই ভাবল মাসি রাখালকে সাগর দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন। দেবতা এখন রাখালকে চায়। ঝঞ্ঝা থেকে নিষ্কৃতির আশায় রাখালকে সাগরে ছুড়ে ফেলল ‘পুণ্যলোভাতুর’ তীর্থযাত্রীরা।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই একবিংশ শতকেও রাখালদের মুক্তি নেই। আক্ষরিক অর্থে ডুবিয়ে মারা না হলেও অভিভাবকদের অসচেতনতা ও উদাসীনতা প্রতিদিন অসংখ্য রাখালকে প্রকারান্তরে ‘অনন্ততিমিরতলে’ ছুড়ে মারছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) গবেষণা প্রতিবেদনে অন্তত তেমনটাই প্রতিভাত হচ্ছে।

সিআইপিআরবির প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শিশু-কিশোর পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। বছরে মরছে সাড়ে ১৪ হাজার শিশু–কিশোর। এই সমস্যা প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু সমস্যা সমাধানে কোনো সামাজিক আন্দোলন বা সচেতনতামূলক কোনো উদ্যোগ নেই। দেখা যাচ্ছে, ৮০ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে পুকুর, ডোবা, বালতি বা পানির পাত্রে। ৮০ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে। আর এই মৃত্যুগুলোকে ‘কপালের দোষ’ বলে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি একরকম প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে।

গবেষণা বলছে, দেশে প্রথম জন্মদিনের পরপরই শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মারা যায় এক থেকে চার বছর বয়সের শিশুরা। এসব ঘটনায় দেখা যায়, বড় পরিবার অর্থাৎ যেসব পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি, সেসব পরিবারের শিশুদের ডুবে মরার ঝুঁকিও বেশি।
সাঁতার জানা, সাঁতার শেখা এই মৃত্যু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ বছর বয়সে শিশু সাঁতার শেখার উপযুক্ত হয়। আবার শিশুদের
যদি দিনের ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে পানি থেকে দূরে রাখা যায়, তাহলে বিপদ এড়ানো সম্ভব। এই চিন্তা থেকে বেশ কয়েকটি জেলায় প্রতিরোধ প্রকল্প বাস্তবায়ন
করছে সিআইপিআরবি। প্রতিষ্ঠানটি দেখেছে, ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে শিশুদের রাখলে ৮০ শতাংশ এবং সাঁতার শেখালে ৯৫ শতাংশ মৃত্যু কমানো সম্ভব।

সিআইপিআরবির প্রতিরোধ কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। সরকারের দিক থেকেও এ ধরনের প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের সাঁতার শেখার বিষয়ে আগ্রহী করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বর্ষাকালে গ্রামীণ এলাকায় বাড়িঘরের চারপাশ যখন জলমগ্ন হয়, তখন বিপদের ঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষ করে এই সময়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালালে বহু শিশুকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।