পরিকল্পনা আছে, বাস্তবায়ন নেই

পরিকল্পিত নগর

গত শনিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা নগর পরিকল্পনায় অভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। আলোচনার বিষয় ছিল ‘পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অনুমোদন প্রক্রিয়া: অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’। স্বাভাবিকভাবে নগর পরিকল্পনায় দুই দেশের তুলনাটি সামনে এসেছে। যেকোনো বিচারে অস্ট্রেলিয়ার নগরায়ণ অনেক বেশি পরিকল্পিত, পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব। তুলনায় বাংলাদেশের নগরায়ণ হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। নগরবিদদের মতে, নীতি পরিকল্পনায় আমাদের খুব বেশি দুর্বলতা না থাকলেও বাস্তবায়নে যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর একটি অস্ট্রেলিয়া। সেখানে লোকসংখ্যা কম। তাই অস্ট্রেলিয়ার নগরায়ণের সঙ্গে বাংলাদেশকে হয়তো মেলানো যাবে না। কিন্তু ভারতের জনবহুল কলকাতা, মুম্বাই কিংবা পাকিস্তানের করাচির নগরায়ণের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার তুলনা করা অস্বাভাবিক নয়। উল্লিখিত তিনটি শহরের নগরায়ণ ঢাকার মতো বিশৃঙ্খল ও অপরিকল্পিত নয়। একসময় কলকাতা খুবই ঘিঞ্জি ও অপরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। যোগাযোগব্যবস্থাও ছিল বেহাল। গত দুই দশকে কলকাতা সেই সমস্যা মোটামুটি কাটিয়ে উঠতে পারলেও ঢাকার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাস অনুপযোগী শহরের তালিকায় এর নাম উঠে এসেছে।

যেকোনো আধুনিক শহরে মোট আয়তনের ২০ শতাংশ খোলা জায়গা থাকা দরকার। ঢাকায় আছে মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ। সড়ক থাকা দরকার ২০ শতাংশ, আছে ৮ শতাংশের কম। পরিকল্পিত নগরে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ভবন ও শিল্পকারখানা থাকে না। আমাদের এখানে আবাসিক-বাণিজ্যিক এমনকি শিল্পভবনও পাশাপাশি আছে। ধানমন্ডি, গুলশান ও বনানী আবাসিক চরিত্র অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে।

 যেকোনো আধুনিক শহরে ভবন নির্মাণের সময় কর্তৃপক্ষ সেখানকার বাসিন্দাদের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে। বিশেষ করে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং যোগযোগ ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা। কিন্তু রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এসব নিয়ে খুব মাথা ঘামায় বলে মনে হয় না। সংস্থাটি পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে বিভিন্ন সময় নানা পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু এর প্রধান দুর্বলতা হলো তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে হার ধারণা করেছে, রাজধানীতে জনসংখ্যা বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত হারে। ঢাকা এখন পৃথিবীর দ্রুত সম্প্রসারিত শহরের একটি। সেই তুলনায় নাগরিক সুবিধা বাড়ছে না।

 ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে রাজউক নগরায়ণের পরিকল্পনা নিয়েছিল, তার বেশির ভাগই ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’-এর মতো। সংস্থাটির কর্মকর্তা জনবল ঘাটতির দোহাই দেন। তাদের জনবল যদি এতটাই কম থাকবে, তাহলে তারা প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রি করছে কেন? একসময় এসব ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তা ছিল না বলে রাজউককে কিছুটা উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হয়েছিল। এখন সেসবের প্রয়োজন নেই। রাজউক প্লট-ফ্ল্যাট বাণিজ্য বাদ দিয়ে যদি তদারকির কাজটি ঠিকমতো করে, তাতে নগরবাসী অধিক উপকৃত হবে।

পরিবেশবান্ধব নগরায়ণের দোহাই দিয়ে রাজউক ২০১০ সালে ঢাকা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ তৈরি করেছিল। সে সময় সরকারের মন্ত্রী থেকে রাজউকের কর্তাব্যক্তি—সবাই ড্যাপ বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের চাপের মুখে তারা সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে এবং নতুন করে পরিকল্পনা তৈরির কাজ করছে। ২০১৬ সালে রাজউক প্রণীত ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান নামে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলে (ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ) ২০৩৫ সাল নাগাদ বৃহত্তর ঢাকার লোকসংখ্যা ২ কোটি ৫০ লাখ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু যেই হারে ঢাকা শহরে মানুষ বাড়ছে, তাতে এই সংখ্যা ৩ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অস্ট্রেলিয়ার কোনো শহরের মতো পরিকল্পিত শহর অনেক দূরের বিষয়, ঢাকাকে মোটামুটি বাসযোগ্য করতে যা যা করা প্রয়োজন, তা করতে রাজউক প্রস্তুত আছে কি?