দ্রুত রায় কার্যকর করাই এখন চ্যালেঞ্জ

নুসরাত হত্যা মামলা

ফেনীর সোনাগাজীর আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান (রাফি) হত্যা মামলার রায় জনমনে স্বস্তি এনেছে। এই রায়ে আবারও এই বার্তা স্পষ্ট হলো যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। গত ১০ এপ্রিল ঘাতকদের আগুনে দগ্ধ নুসরাত হাসপাতালে মারা যান। ৩৩ কর্মদিবসে তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র এবং মাত্র ৬১ কার্যদিবসে রায় পেলাম। এটা এক বড় সাফল্য। অবশ্য একই সঙ্গে আমরা স্মরণ রাখব যে বিচারিক আদালতে দ্রুত রায়দান হলো একটি প্রাথমিক পর্যায়ের সমাপ্তি। এখন এই রায়ের কার্যকারিতা বিষয়ে রায় দেবেন উচ্চ আদালত।

মৃত্যুদণ্ডের রায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক বেড়ে গেছে। সে জন্য হাইকোর্টের ওপর চাপ বেড়েছে। বর্তমানে তিনটি হাইকোর্ট বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতের শুনানি করছেন। এ ক্ষেত্রে বছরের ক্রম রক্ষার নিয়ম মানা হয়। এখন ২০১৬ সালের ফাঁসির মামলার শুনানি চলছে। সুতরাং প্রধান বিচারপতি যদি হস্তক্ষেপ না করেন, তাহলে নুসরাত হত্যা মামলার শুনানির জন্য ‘কয়েক বছর’ কেটে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এরপর বাকি থাকবে আপিল বিভাগে দুই পর্ব। আপিল ও রিভিউ। রাষ্ট্রপতির ক্ষমাও বিবেচনায় রাখতে হবে। সুতরাং ‘দ্রুত বিচারের’ মানদণ্ড কী, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

২০০৬ সালে বিচারিক আদালতে বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের ফাঁসির রায়ের তিন মাসের মধ্যে হাইকোর্ট শুনানি শেষে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। আপিল বিভাগে আপিল খারিজ ও রাষ্ট্রপতির তরফে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ শেষে ফাঁসি কার্যকর হতে ২০০৭ সালের মার্চ লেগে যায়। তৎকালীন সরকারের উদ্যোগের কারণে এটা সম্ভব হয়েছিল।

ঝালকাঠির দুই বিচারক খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ফাঁসি হয়েছে সাড়ে ১৬ মাসে। নুসরাতের হত্যার পর ছয় মাস কেটে গেছে। আগামী ১০ মাস বা এক বছরের মধ্যে পুরো বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। দ্রুত বিচারের বিষয়টি স্বস্তিদায়ক হলেও এর প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। রাষ্ট্র একটি ‘অগ্রাধিকারভিত্তিক বা আদেশভিত্তিক’ ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করছে কি না, তা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। যেসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বেশি আলোচিত, সেসব ক্ষেত্রে অপরাধী গ্রেপ্তার, রিমান্ড, অভিযোগপত্র দাখিল, রায় প্রদানে ‘দ্রুত বিচার’ হতে দেখি। যেহেতু প্রচলিত ব্যবস্থা একটা জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের ওপর চেপে আছে, তাই আমরা এ ধরনের ‘দ্রুত বিচারে’ সান্ত্বনা খুঁজি। কিন্তু সত্যিই কি এ ধরনের ব্যবস্থা সমাজে ন্যায়বিচারের বোধ তৈরি করতে যথেষ্ট সহায়ক হচ্ছে? ফেনীর আদালত সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার যে প্রশংসা করেছেন, সেটা কিন্তু এক অর্থে প্রচলিত ব্যবস্থার দুর্বলতার নির্দেশকও বটে।

ফেনীর আদালতে গতকাল নুসরাত হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ১৬ আসামির প্রত্যেকেই সর্বোচ্চ দণ্ড পেয়েছেন। এর সঙ্গে প্রত্যেককেই এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আইনের চোখে যদিও এই দণ্ডদান একটি প্রস্তাব মাত্র। কিন্তু এই দণ্ডদান কাঠামো সুবিবেচনাপ্রসূত কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আইনবিদদের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিমত দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।

আশা করব, নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায় হাইকোর্টে অনির্দিষ্টকাল পড়ে থাকবে না। দণ্ডিত অপরাধীরা ন্যক্কারজনকভাবে অসদাচরণ করেছেন। সমাজে তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণেই তাঁরা এমন একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সাহস পেয়েছিলেন। এমন একটি ঘটনা ঘটিয়ে তাঁরা পার পেয়ে যেতে পারবেন, এমন ধারণা সম্ভবত তাঁদের মধ্যে ছিল। ফলে নিম্ন আদালতের রায় অকার্যকর করতে তাঁরা নানা রকম ফন্দিফিকির করতে পারেন। অতএব, সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

বিচারিক আদালতের রায় হলো বিচারের প্রাথমিক ধাপ। ন্যায়বিচার তখনই নিশ্চিত হবে, যখন সর্বোচ্চ আদালতে নুসরাত হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে।