সড়ক যেন অপমৃত্যুর স্থায়ী বন্দোবস্ত

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল

রাত পোহালেই নতুন জীবন—বিয়ে, কিন্তু এর আগেই সড়কে প্রাণ গেল যুবকের। ছেলেকে মাইক্রোবাসে তুলে দিয়ে বাবা বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। মাকে দেখতে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে পারলেও বাড়িতে পৌঁছানোর রাস্তায় হয়ে গেল নিথর মৃতদেহ। বাংলাদেশের সড়কে এমন সব করুণ কঠিন ট্র্যাজেডির জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন। এই ট্র্যাজেডির বার্ষিক পরিসংখ্যান হলো প্রায় আট হাজার মৃত্যু। প্রাকৃতিক দুর্যোগও মোকাবিলা করা যায়, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা নামক গণমৃত্যুর এই ফাঁদ কি কিছুতেই দূর করা যায় না?

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন। আর আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০ জন। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেশি। অবস্থা যা, তাতে ২০২০ সালের হিসাব ২০১৯ সালের চেয়ে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। সড়ক-মহাসড়কে অপমৃত্যুর এই স্থায়ী বন্দোবস্তই যেন বাংলাদেশে ‘নতুন স্বাভাবিকতা’। এটাই যেন অলঙ্ঘনীয় নিয়তি। বছর যায়, দশক যায়, কিন্তু সড়কে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনায় সত্যিই কিছু করা হয় না। সরকারি বয়ান যত গর্জে তত বর্ষে না। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ঢাকার কিশোরেরা সহপাঠীর মৃত্যুতে রাস্তায় নেমে অভূতপূর্ব আন্দোলন করেছিল। জাতির বিবেককে ঝাঁকুনি দিয়েছিল সেই আন্দোলন। সমাজে ব্যাপক আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো টনকই নড়েছে বলে মনে হয় না। এত মৃত্যু, এত কান্না, এত আন্দোলন, এত আবেদন-নিবেদনের পরও যে সড়ক পরিবহন আইন–২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে, তা সংকটের মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। বলা যায়, সংঘবদ্ধ শ্রমিক-মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে পথচলাই যেন জীবন এখন।

করুণ পরিহাস এই যে সড়কে দুর্ঘটনা নামক কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হলেন পরিবহনচালক ও শ্রমিক। নিজের ও যাত্রীদের প্রাণ হাতে করে চলতে তাঁরাও বাধ্য, বাধ্য নিজ নিজ একগুঁয়েমি, অশিক্ষা, অসতর্কতা ও দুর্নীতির কাছে হার মেনে সড়ককে অনিরাপদ করতে।

পরিবহনশ্রমিকদের ওপর মালিকদের সব চাহিদাই অতিরিক্ত। অতিরিক্ত সময় ধরে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করানো, ফিটনেস না থাকা গাড়ি মেয়াদের অতিরিক্ত ব্যবহার করা: ফল হলো দুর্ঘটনা। এসব কি কোনো দৈব কারণ, যা দূর করা যায় না?

প্রথম আলোয় ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য দেখায়, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান এবং মোটরসাইকেল যৌথভাবে ৫০ শতাংশের বেশি দুর্ঘটনার কারণ ও শিকার। এরপর রয়েছে ১৯ শতাংশ বাস দুর্ঘটনা। অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের সমস্যা এবং চালকের ত্রুটি। এই দুটি কারণেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয়। এই দুটি দেখার দায়িত্ব কিন্তু মালিকপক্ষ ও সরকারপক্ষের। সরকার যদি যথাযথ নজরদারি করে, তাহলে মালিকদের পক্ষে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় বের করা সম্ভব হতো না। ঈদের সময় তো বটেই, অন্যান্য সময়ও চালকদের অক্লান্তভাবে গাড়ি চালাতে বাধ্য করা বন্ধ করতে পারে একমাত্র সরকার। অথচ শ্রমিক ও সরকার উভয়ই যেন মালিকপক্ষের কাছে জিম্মি। পরিবহন খাতের মাফিয়াকরণ, সড়কে যান চলাচলের কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর দুর্নীতি এবং এসবের সুফলভোগী রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্বহীনতার শিকার আমরা সবাই।

দিনের শেষে বলতে হয়, সরকার একশ্রেণির পরিবহন নেতা ও মালিকের কাছে যতটা দায়বদ্ধ, ততটা দায়বদ্ধ সড়কে নিরাপত্তার ব্যাপারে নয়, জনগণের কাছে নয়। এটা দুঃখজনক, হতাশাময়, মর্মান্তিক এবং নিষ্ঠুর।