অপব্যবহারের উদ্বেগ অমূলক নয়

দুদকের নতুন বিধি

দুর্নীতি দমন কমিশনই (দুদক) দেশের একমাত্র সংস্থা নয়, যার ওপর ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি দেওয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। আইন বলছে, ছোট-বড় প্রতিটি সরকারি দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিকভাবে অনিয়ম রোধে সজাগ থাকবেন, প্রয়োজনে অভিযুক্তকে তিরস্কার, সতর্ক কিংবা বরখাস্ত করবেন। বিভাগীয় মামলা করবেন। সন্দেহ হলেই তদন্ত করাবেন। কিন্তু বড় বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার নজির খুবই কম। অথচ ক্ষমতার কারও কোনো ঘাটতি নেই। দুদককে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা করতে অনেক কসরত গেছে। তার বর্তমান ক্ষমতা কাজের কাজ করে দেখানোর জন্য যথেষ্ট। তবে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে সন্তোষজনক কিছু করার নজির প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করতে পারেনি। এ অবস্থায় আমরা আগের ক্ষমতার আওতা আরও বাড়ানোসংক্রান্ত একটি নতুন প্রজ্ঞাপন পেলাম। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই দুদকের এই ক্ষমতা বৃদ্ধির খবরে উৎসাহিত হচ্ছেন না।

দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলমান দুর্নীতির ব্যাপকতা রোধে রাষ্ট্রযন্ত্র সাফল্য অর্জন থেকে বহু দূরে রয়েছে। সার্বিক বিচারে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতির কারণেই দুর্নীতির রাশ টানা যাচ্ছে না। দুর্নীতিগ্রস্তদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে যেকোনো রাষ্ট্রের জনপ্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজন একটি অনুকূল রাজনৈতিক পরিমণ্ডল। কিন্তু বাংলাদেশে তা যথেষ্ট অনুপস্থিত।

সম্প্রতি অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত একজন ডিআইজির সঙ্গে দুদকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ‘ঘুষ কেলেঙ্কারি’ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমরা দেখলাম যে ঘুষ লেনদেনের সন্দেহজনক অডিও টেপ প্রকাশের পরই কেবল ডিআইজির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা এবং তাঁর বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা এল। উচ্চ আদালতে ‘হাইপ্রোফাইল’ দুর্নীতির মামলা পরিচালনা নিয়ে দুদক গর্ববোধ করে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেই মামলাগুলোর প্রায় ষোলো আনাই এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের। ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহভাজনদের প্রতি দুদক আইনের আপন গতির চর্চা খুবই কম করতে পেরেছে।

দুদক নিজেদের অপারগতা ঢাকতে গিয়ে ‘চুনোপুঁটি ধরি’ কিংবা অভিযোগপত্র না দিয়ে ‘টাকা পুনরুদ্ধার’–এর আওয়াজ তুলেছে। সুতরাং নতুন বিধি দুদকের কাজকে গতিশীল ও সফল হতে সহায়তা করবে এমন অনুমান করার সংগত কারণ নেই। নতুন বিধান অনুযায়ী তদন্ত বা অনুসন্ধানের জন্য দুদক আয়কর বিভাগ এবং ব্যাংকগুলো থেকে ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য সরাসরি তলব করতে পারবে। গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে অভিযোগ অনুসন্ধান না করেই দুদক সরাসরি মামলা করতে পারবে। কিন্তু সন্দেহভাজন ব্যক্তির সরাসরি আয়কর নথি বা ব্যাংক বিবরণী তলব এবং গুরুত্ব বিবেচনায় অনুসন্ধান ছাড়াই সরাসরি মামলা করার সামর্থ্য দুদকের এত দিন একেবারে ছিল না, তা নয়। কিছুটা অস্পষ্টতা ছিল। অন্তত তিন-চার বছর আগেই সোনালী পাটকলের মামলায় আপিল বিভাগ সুরাহা দেন যে দুদক ব্যাংক বিবরণী তলব করতে পারবে। কিন্তু এই এখতিয়ার অর্জন করার পরের বছরগুলোতে রুই-কাতলাদের বিষয়ে দুদক তার এই এখতিয়ার প্রয়োগ করেছে বলে জানা যায় না।

দুদকের বিধি সংশোধনের ফলে এখন এই আশঙ্কা জোরালো হয়েছে যে প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হওয়ার পরিবর্তে তাঁদের নেকনজর নিশ্চিত করতে দুদক কোনো মহলের ইঙ্গিতে তার লব্ধ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে পারে। স্বাধীন সংস্থার ক্ষমতায়ন চাওয়া হয় তার নিরপেক্ষ প্রয়োগের আশায়, এখানেই তার সার্থকতা। কিন্তু এর অপপ্রয়োগ হওয়ার অর্থ হচ্ছে সরকারে যঁারা আছেন তাঁদের নিরাপদ রাখা ও সুবিধামতো যঁাকে-তঁাকে অহেতুক হয়রানি করা। স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দুদকের সামর্থ্য বৃদ্ধির বিষয়টি নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য। কিন্তু দুদকের কাঁধে বন্দুক রেখে কেউ যদি তার নিশানা স্থির করতে পারে, তবে তা হবে বিপজ্জনক।