বাংলাদেশে অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যের হারও কমে আসছে, এটি আশার কথা। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো দারিদ্র্য কমার ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে বেশ ফারাক রয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে যে হারে দারিদ্র্য কমছে, সেই হারে শহরে কমছে না। অন্যদিকে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে শহরাঞ্চল উপেক্ষিত থাকছে। শহরে বসবাসকারী দরিদ্রদের মাত্র ১৭.৮৪ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকারি সহায়তা পেয়ে থাকে; যেখানে গ্রামাঞ্চলে ৩৫.৭৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষ এই সুবিধা ভোগ করে।
গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান না থাকা, নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে দরিদ্র মানুষ শহরে ভিড় জমায়। সেখানে তারা বেঁচে থাকার মতো কাজ জোগাড় করতে পারলেও ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে বাসস্থানসংকটের কারণে এদের একাংশ বস্তিতে থাকার জায়গা করে নিতে পারলেও অন্যদের ঠাঁই হয় বাস টার্মিনাল, ফুটপাত বা উন্মুক্ত স্থানে; যারা ভাসমান মানুষ হিসেবে পরিচিত।
চলতি অর্থবছরে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যা মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ। সার্বিক বিবেচনায় এটি কম না হলেও শহর ও গ্রামাঞ্চলে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বড় রকমের বৈষম্য রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, ২০১০-২০১৬ সালে শহরের দারিদ্র্য ২১.৩ থেকে কমে ১৯.৩ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু অতিদারিদ্র্যের হার ৭.৭ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্য কমেছে ৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ শহরাঞ্চলে অতিদরিদ্রদের সংখ্যা আরও বেড়েছে। সরকারের ভুল নীতির কারণেই এটি হয়েছে।
গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের বরাদ্দ যেমন বেশি, তেমনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও অনেক বেশি সক্রিয়। তুলনায় শহরাঞ্চলে
তাদের কার্যক্রম খুবই সীমিত। সরকার অন্যান্য ক্ষেত্রে শহরকে অগ্রাধিকার দিয়ে এলেও অতিদরিদ্রদের সহায়তার বিষয়ে এই উদাসীনতা মেনে নেওয়া যায় না।
বিশ্বব্যাংক স্বীকার করেছে যে ২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ সফলতা দেখিয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে দরিদ্রের হার ৩০ শতাংশের ওপর ছিল, সেখানে তা ২১ শতাংশে নামিয়ে আনা প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু শহর ও গ্রামের দরিদ্রদের প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক নীতি মেনে নেওয়া যায় না। আর বৈষম্য শুধু গ্রাম ও শহরের দরিদ্রদের মধ্যে নেই, অঞ্চলভেদেও এটি প্রকট রূপ নিয়েছে। দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলে এখন মঙ্গা না থাকলেও দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। সে ক্ষেত্রে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে শহর ও গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি আঞ্চলিক বৈষম্য কমানোর ওপরও জোর দিতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মুখে সুষম উন্নয়নের কথা বললেও সরকারের গৃহীত কর্মসূচিতে তার প্রতিফলন দেখা যায় না।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০-১৬ সময়ে দারিদ্র্য বিমোচনের ৯০ শতাংশই হয়েছে গ্রামে। গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য কমুক, সেটা আমরাও চাই। কিন্তু শহরাঞ্চলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে কিংবা অতিদরিদ্রের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি কোনো সুফল দেবে না। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে শহরের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে ৬৫ শতাংশ ও শহরে ৩৫ শতাংশ মানুষ বাস করে। অদূর ভবিষ্যতে শহর ও গ্রামের জনসংখ্যার ফারাক আরও কমে যাবে।
এ অবস্থায় সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন নীতির অগ্রাধিকারেও পরিবর্তন আনতে হবে। শহরের দারিদ্র্য কমাতে হলে অবিলম্বে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। তাদেরও সেকেলে চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।