জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের বিরুদ্ধে আবারও দুর্নীতির নির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বৃহস্পতিবার বলেছে, ৬৮ কোটি টাকার ৭ প্রকল্পই রাজনৈতিক সুপারিশে অনুমোদন পেয়েছিল এবং এর মধ্যে ৩৭ কোটি টাকা খরচের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। এই তহবিলের বিরুদ্ধে গোড়া থেকেই ধারাবাহিকভাবে অনিয়মের অভিযোগ লেগে আছে। অথচ এটা ছিল সরকারের একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত।

এটা সুবিদিত যে জলবায়ু পরিবর্তনের সব থেকে খারাপ প্রভাব পড়বে যেসব দেশে, তার অন্যতম বাংলাদেশ। কিন্তু উন্নত বিশ্ব তাদের দায়ের অনুপাতে এ ধরনের ভঙ্গুর রাষ্ট্রগুলোকে ন্যায্য অর্থায়নে উদাসীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই অন্যের সাহায্য লাভের আশায় কালক্ষেপণের নীতি পরিহার করেন। ২০০৯ সালে তিনি বিশ্বের সামনে একটি রোল মডেল তৈরি করতে যথার্থই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল নিজস্ব অর্থায়নে এ রকম একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিশ্বের সবার সামনে অনুসরণীয় উদাহরণ হাজির করা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা বাড়ানো এবং জীববৈচিত্র্য সুরক্ষাই এর লক্ষ্য। এই ট্রাস্ট গঠনের এক যুগ পূর্তি সামনে। আমরা এই ট্রাস্ট গঠন এবং তার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আইনি বিধিবিধানের উপস্থিতি দেখতে পাই। পরিবেশমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোর্ড এবং তঁার সহায়তায় সচিবের নেতৃত্বে কারিগরি কমিটি রয়েছে। কিন্তু পরিহাসের সঙ্গে বলতে হয়, যেটা দেখতে পাই না সেটা হলো, এসব বিধিবিধান কীভাবে অনুসরণ করে কী কী ফল পাওয়া গেছে।

ট্রাস্টের প্রকল্প চেকলিস্টে লেখা আছে: প্রকল্প প্রস্তাবটিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব/সচিবের সই আছে কি না। সুতরাং ধরে নিতে হবে যে তিন প্রকল্প অনুমোদনে ‘তৎকালীন একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীকে প্রকল্পের ১০ শতাংশ অর্থ অগ্রিম ঘুষ’ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, সেই প্রকল্প প্রস্তাবগুলোও যথারীতি সচিবের স্বাক্ষরিত ছিল। আমরা স্মরণ করতে পারি, আট বছর আগে প্রথম আলোর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গৃহীত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উভয়ের তরফে অজলবায়ুসংশ্লিষ্ট প্রকল্প আছে, যা ট্রাস্ট গঠনের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। উপরন্তু এমন সব এনজিওকে কাজ দেওয়া হয়েছে, যারা অভিজ্ঞতাহীন, নতুন গজিয়ে ওঠা। আবার কোনো কোনো মন্ত্রীর এলাকায় বৈষম্যমূলকভাবে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরপর পিকেএসএফের দ্বারা তদন্তে সেই অভিযোগ প্রমাণিত হলে কিছু প্রকল্প বাতিল হয়েছিল। কিন্তু প্রতীয়মান হয়, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। কারণ, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ট্রাস্টের অধীন বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ লেগেই আছে। কিন্তু কেউ শাস্তি পেয়েছেন বলে জানা যায় না। এবং শুরুতে চার হাজার কোটি টাকা দিয়ে তহবিল গঠন করা হলেও ধীরে ধীরে এর সংকোচন ঘটছে। কিন্তু স্পষ্টতই এটা কোনো সমাধান নয়। শুধু ‘মুখ রক্ষার’ জন্য একে বয়ে বেড়ানো অর্থহীন ও আত্মঘাতী। ট্রাস্টের ওয়েবপোর্টালে ‘অর্জন’ ক্লিক করে বিভ্রান্ত হতে হবে। সেখানে কতটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং তা কী পরিবর্তন এনেছে, তার বিবরণ নেই।

২০১০ সালের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক প্রতিবছর প্রকল্পের নিরীক্ষা করবেন এবং নিরীক্ষা রিপোর্টের অনুলিপি সরকার ও বোর্ডের কাছে পেশ করবেন। প্রকল্পের সার্বিক ও আর্থিক দায়ভার প্রকল্প পরিচালক/বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়/সংস্থার ওপর বর্তাবে। আমরা সিঅ্যান্ডএজির প্রতিটি রিপোর্ট ট্রাস্টের ওয়েবপোর্টালে অবিলম্বে দেখতে চাই। এই রিপোর্ট গোপন রাখা একটি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম। নির্মোহভাবে ট্রাস্টের পুরো কার্যক্রম খতিয়ে দেখা হোক। জলবায়ু পরিবর্তন এখন সাধারণভাবে সব প্রকল্পেই যুক্ত। তাই ট্রাস্ট কেন থাকবে, থাকলে কীভাবে, সেটা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।