সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন

ছোট জনপদে বড় সংঘাত

রাঙামাটি জেলার ছোট উপজেলা রাজস্থলীতে গত ১১ মাসে ১২ জন মানুষ খুন হওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক ঘটনা। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলার ২৬ উপজেলার মধ্যে রাজস্থলীতে খুনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর অর্থ এই নয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলে শান্তি বিরাজ করছে। নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ি সদরসহ বিভিন্ন স্থানে খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণের ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব স্থানে সংঘাতের কারণ মূলত আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যকার বিরোধ। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সইয়ের পর চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি থেকে বেরিয়ে গিয়ে একাংশ গঠন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ। পরে দুই সংগঠনই ভেঙে যায় এবং এখন চারটি আঞ্চলিক সংগঠন সক্রিয় আছে।

কিন্তু রাজস্থলীতে জনসংহতি সমিতি ছাড়া অন্য কোনো আঞ্চলিক সংগঠনের তৎপরতা নেই। তারপরও সেখানে উপর্যুপরি হত্যা ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে এবং এ জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাজস্থলীর রাইখালীর কারিগরপাড়ায় জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) কর্মী মংসুইন মারমা (৪০) ও স্থানীয় মো. জাহেদ (২৫) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। এরপর বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম গ্রাম সামাখালপাড়া থেকে সন্ত্রাসীরা কার্বারিসহ ছয় গ্রামবাসীকে অপহরণ করে। গত ১৯ আগস্ট একই উপজেলার মিনঝিরি রাস্তার মাথা থেকে তিন গাড়িচালক ও তাঁদের তিন সহযোগী অপহৃত হন সন্ত্রাসীদের হাতে। পরে অবশ্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের উদ্ধার করেন। গত ২৩ অক্টোবর রাজস্থলী উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ও ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দীপময় তালুকদার খুন হন। সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর গুলিতে নিহত হন আরও তিনজন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য স্থানে আঞ্চলিক দলগুলো কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লিপ্ত হলেও রাজস্থলীতে জনসংহতি সমিতি ছাড়া অন্যদের তেমন কার্যক্রম নেই। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত সাধারণ নির্বাচনের আগে আরাকান লিবারেশন পার্টির একাংশ মগ পার্টি নামে আবির্ভূত হয়। জনসংহতি সমিতির অভিযোগ, তাদের বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলো মগ পার্টিকে আশকারা দিচ্ছে। মগ পার্টি বিগত জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করেছে বলেও নালিশ তাদের। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, আঞ্চলিক দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে সেখানে খুনখারাবি হচ্ছে। 

খুনখারাবি যেই করে থাকুক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। মগ পার্টি যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, সেটিও কারও অজানা নয়। তারপরও তারা কীভাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঢুকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে? এ ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠন শুধু জনজীবনের নিরাপত্তা নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যও বিপজ্জনক। কিন্তু আঞ্চলিক কিংবা ক্ষমতাসীন কোনো দলই সেই বিপদের কথা মাথায় রাখছে বলে মনে হয় না। তারা একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে।

মিয়ানমারে যেই বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠনটি নিষিদ্ধ, সেই সংগঠনটি ভিন্ন নামে কীভাবে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে? মগ পার্টির ঘাঁটি বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) এ বিষয়ে আরও বেশি সজাগ থাকতে হবে। সীমান্তে এমন সুরক্ষা ব্যূহ তৈরি করতে হবে, যাতে মগ পার্টি বা অন্য কোনো সংগঠনের কেউ বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ভেতরে কেউ ঢুকে পড়লে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে নিরবচ্ছিন্ন ও সর্বাত্মক। 

২২ বছর আগে সই হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কতটি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, কতটি হয়নি, সেই হিসাব–নিকাশ করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, সেখানে শান্তি এসেছে কি না? পাহাড়ি জনপদের মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে কি না?