শীতলক্ষ্যায় লঞ্চ দুর্ঘটনা

ছোট আকারের লঞ্চগুলো তুলে নিন

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

গত রোববার সন্ধ্যায় শীতলক্ষ্যা নদীর চর সৈয়দপুর কয়লাঘাট এলাকার নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুসংলগ্ন স্থানে যে লঞ্চডুবির ঘটনায় ৩৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে, তা অনিবার্য ছিল না। কারণ, আমরা একটি ভিডিও চিত্রে দেখেছি এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকেও জেনেছি, লঞ্চটি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েনি, সেটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে একটি কার্গো জাহাজ। ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীবাহী লঞ্চটি ডুবে যায়নি, কাত হয়ে পড়েছিল, তখন লঞ্চটি থেকে যাত্রীদের অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন; এই অবস্থায় আঘাতকারী কার্গো জাহাজটি লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিয়েই অগ্রসর হয়।

অর্থাৎ, যাত্রীবাহী লঞ্চটির ডুবে যাওয়া এবং এত মানুষের প্রাণহানির দায় বর্তায় কার্গো জাহাজের চালকের ওপর। এই দুর্ঘটনা তদন্তের উদ্দেশ্যে যে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের তদন্তের ফলাফলে বিশদ তথ্য পাওয়া গেলে পরিস্থিতি আরও পরিষ্কার হবে। অনেক আগে থেকেই জানা, নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছে নদীর ওই অংশটি সরু হয়ে গেছে; সেখানে নৌযান চলাচলে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োজন—এমন কথা অনেক শোনা গেছে। কিন্তু সেখানে নৌ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা যে নেই, তা রোববারের দুর্ঘটনার ভিডিও চিত্র থেকে স্পষ্ট হয়েছে। নদীর ওই অংশে নৌযান চলাচলে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এমন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকেই যাবে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যায়। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে ঝড়বৃষ্টির মৌসুমে। এখন সেই মৌসুম চলছে। রোববারের দুর্ঘটনার কারণ ঝড়বৃষ্টি না হলেও এটাকে এই মৌসুমের প্রথম সতর্কতা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। শীতলক্ষ্যা নদীর ওই অংশসহ অন্যান্য স্থানে সম্ভাব্য নৌ দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা প্রয়োজন; এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। রোববারের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কার্গো জাহাজটির চালক ও সংশ্লিষ্ট লোকজনকে শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি নৌ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিও চাইতে হবে।

নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির কারণগুলোর অন্যতম হলো লঞ্চগুলোতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন। এমনিতে ঝড়বৃষ্টির মৌসুমে ছোট আকারের নৌযানের দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, অতিরিক্ত যাত্রী থাকলে সেই আশঙ্কা আরও অনেক বেড়ে যায়। সে জন্য ৫০-৬০ ফুট আকারের ছোট লঞ্চগুলোর সংখ্যা ও চলাচলের রুট সীমিত করে বড় আকারের নৌযানের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। দুর্ঘটনা এড়াতে এবং ব্যবসায়িক সুবিধার্থে অনেক নৌযানের মালিক ছোট লঞ্চের বদলে বড় লঞ্চ নদীতে নামাতে চান, কিন্তু এমন অভিযোগ রয়েছে যে কায়েমি স্বার্থের কারণে বড় লঞ্চের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। এই অভিযোগ সত্য হলে অবশ্যই অবিলম্বে এর প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে হবে। পুরোদমে ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই ছোট আকারের সব লঞ্চ নদী থেকে সরিয়ে নিয়ে বড় আকারের লঞ্চ নামানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক। বড় আকারের লঞ্চগুলোতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের প্রয়োজন থাকে না, তা ছাড়া ঝড়বৃষ্টিতে ছোট লঞ্চগুলো যত সহজে ডুবে যেতে পারে, বড়গুলো তত সহজে ডোবে না।

তবে লঞ্চের আকার শুধু নয়, যাত্রী পরিবহনের সব নিয়মকানুন যথাযথভাবে মেনে চলা এবং নৌ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে দক্ষতা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর মধ্য দিয়ে নৌ দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এই ঝড়বৃষ্টির মৌসুমে আর কোনো নৌ দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানির পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়।