রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে সবচেয়ে বড় যে তাগিদ ছিল, তা বুড়িগঙ্গা নদীকে ওই শিল্পের দূষণ থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া এবং হাজারীবাগ ও তার আশপাশের এলাকায় যে বিপুল জনগোষ্ঠীর বসবাস, তাদের দূষণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি দূর করা। এখন দেখা যাচ্ছে, এই শিল্প স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে দূষণও স্থানান্তরিত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার খবর বেরিয়েছে, সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় যে নতুন চামড়াশিল্পপল্লি গড়ে তোলা হচ্ছে, সেটি পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীর জন্য একই বিপদ সৃষ্টি করেছে। কারণ, সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বস্তুত কিছু নেই। চামড়া প্রক্রিয়াকরণের ফলে উৎপন্ন বর্জ্য পরিশোধন না করেই আশপাশের নালা-ডোবা ও নদীর ধারে ফেলা হচ্ছে। ডাম্পিং ইয়ার্ড উপচে বর্জ্য গিয়ে পড়ছে ধলেশ্বরী নদীতে; ইতিমধ্যে ধলেশ্বরীর তীরে তিনটি বড় নালার সৃষ্টি হয়েছে। পশুচামড়ার ঝিল্লি পচে উৎকট দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। ধলেশ্বরী নদীর দূষণের ফলে মাছ মরে ভেসে ওঠার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
সাভারের হেমায়েতপুর এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশে এই বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে হাজারীবাগ থেকে সব চামড়া কারখানা সেখানে স্থানান্তরিত হওয়ার আগেই। ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে গত দেড় দশকে সেখানে শতাধিক কারখানা স্থানান্তর করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কারখানা স্থানান্তরের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে ১১ বার। তারপরও সব কারখানা সেখানে স্থানান্তর করা হয়নি। অর্থাৎ চামড়াশিল্পের দূষণ থেকে হাজারীবাগ ও বুড়িগঙ্গা নদী তো মুক্তি পায়ইনি, উপরন্তু সাভারের হেমায়েতপুর ও ধলেশ্বরী পড়েছে নতুন দূষণের কবলে।
হেমায়েতপুরে নতুন চামড়াশিল্পপল্লি গড়ে তোলার পরিকল্পনায় বর্জ্য পরিশোষণ ও নিষ্কাশনের যে শর্তগুলো রয়েছে, সেগুলো মানা হচ্ছে না। কারখানাগুলোর নিজ নিজ অপরিশোধিত বর্জ্য স্ক্রিনিং ও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারে সেগুলো পরিশোধন ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা এখনো গড়ে তোলা হয়নি। কঠিন ও তরল বর্জ্য পৃথক্করণের কারিগরি ব্যবস্থা নেই। চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অতিমাত্রায় ক্ষতিকর বর্জ্য উৎপন্ন হয়; সেগুলো যথাযথভাবে পরিশোধন ও নিষ্কাশন নিশ্চিত করা না হলে আশপাশের পরিবেশে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
হেয়ায়েতপুরের চামড়াশিল্পপল্লিতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) চালু না করার ফলে শুধু যে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি বাড়ছে, তা নয়, খোদ চামড়াশিল্পের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ থেকে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমে যাচ্ছে। এশিয়া ফাউন্ডেশন ও পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। পরের বছর তা কমে ১০৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারে নেমে আসে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে মাত্র ৭৭ কোটি ডলার।
আমাদের চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি এভাবে কমে যাওয়ার প্রধান কারণ, এই খাত যথেষ্ট কমপ্লায়েন্স অর্জন করতে পারেনি। কমপ্লায়েন্স সমস্যার কারণে আমাদের চামড়াশিল্প লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের বৈশ্বিক সংগঠনের মানসনদ অর্জন করতে পারেনি। এর অন্যতম বড় কারণ চামড়াশিল্পপল্লির সিইটিপি কার্যকর নয়। সম্প্রতি এক সেমিনারে শিল্পপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী মন্তব্য করেছেন, ‘আমাদের চামড়া খাতের জন্য প্রথম কাজ হওয়া উচিত সিইটিপি কার্যকর করা।’ শুধু চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়া ঠেকানোর জন্য নয়, ধলেশ্বরী নদীসহ আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণ এড়ানোর প্রয়োজনে চামড়াশিল্পের বর্জ্য পরিশোধনের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাটি কার্যকর করা একান্ত জরুরি। এ ব্যাপারে আর কালক্ষেপণের সুযোগ নেই।