সন্তান হত্যার বিচারের দাবিতে এক মা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, জাহেদা আমিন চৌধুরী নামের সেই মা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে লুটিয়ে পড়ে সন্তান হত্যার বিচার চাইছেন। এর আগে তিনি অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। গত বছর শহীদ মিনারের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচিও নিয়েছিলেন। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে অনশন প্রত্যাহার করেছেন, কিন্তু মামলার অগ্রগতি নেই; অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়নি।
২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর পুলিশ জাহেদা আমিন চৌধুরীর ছেলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে। দুই দফা ময়নাতদন্তের পর নিশ্চিত হয়, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ নভেম্বর মা জাহেদা আমিন চৌধুরী ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আলমগীর টিপু, সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীসহ ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। আসামিদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন।
বিচার–প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপ অভিযোগপত্র দায়ের করা। গত তিন বছরেও মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হয়নি। তাহলে কেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা মাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন? সেই বিচার না পাওয়া মা যখন দেখলেন, তাঁর সন্তান হত্যার এক আসামির ছবি ছাপা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরে, তখন তাঁর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। উদ্যোক্তাদের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েও কোনো প্রতিকার না পেয়ে ক্রীড়া অনুষ্ঠানের মাঠেই লুটিয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মায়ের এই প্রতিবাদ আমাদের অসুস্থ রাজনীতি ও ভঙ্গুর বিচারব্যবস্থার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
শুধু ইরফান চৌধুরী নন, গত দুই দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন, বেশির ভাগই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, একটি মামলারও বিচার হয়নি। ১৪টি মামলার অভিযোগপত্র পেশ করা হলেও আসামি ও সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় বিচারকাজ এগোচ্ছে না। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব হত্যা মামলার আসামিদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন, কেউ এখনো ছাত্রলীগের রাজনীতি করছেন। কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, তিনি ছাত্র হত্যার বিচার চান। তাহলে প্রশ্ন, কীভাবে হত্যা মামলার আসামিরা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন? তাঁর প্রথম কর্তব্য হত্যা মামলার আসামিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা। মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা চাকরি করতে পারবেন না। অভিযুক্তরা অপরাধী না নিরপরাধ, তা নির্ধারণ করবেন আদালত, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নয়।
চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ দুই গ্রুপে বিভক্ত। এক গ্রুপ মেয়র আ জ ম নাছিরের এবং অপর গ্রুপ সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যাওয়ার পরও যে এই কোন্দল বন্ধ হয়নি, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক কালে ছাত্রলীগের সংঘাত-সংঘর্ষ। দিয়াজ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তাঁর হত্যা মামলা নিয়ে যদি এ রকম কানামাছি খেলা চলে, তাহলে অন্যান্য হত্যা মামলার পরিণতি অনুমান করা কঠিন নয়।
অবিলম্বে দিয়াজ হত্যার বিচার হোক, অপরাধীরা শাস্তি পাক। মা কখনোই তাঁর নিহত সন্তানকে ফিরে পাবেন না। কিন্তু হত্যার বিচার হলে অন্তত তিনি এই সান্ত্বনাটুকু পাবেন যে দেশে ন্যায়বিচার আছে।