জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন

চট্টগ্রামে ভুয়া এনআইডি

চট্টগ্রামে ৪৭টি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সন্ধানলাভের ঘটনার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন সরাসরি জড়িত। একজন রোহিঙ্গা নারীর ভুয়া এনআইডি নেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে প্রাথমিক তদন্ত হলো, তা গভীর উদ্বেগজনক। কারণ, ভুয়া এনআইডির উদ্‌ঘাটন এই প্রশ্ন সামনে এনেছে যে জাতীয় সার্ভারের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হয়েছে কি না। 

জাতীয় সার্ভার রয়েছে শেরেবাংলা নগরে। নিয়ম অনুযায়ী, আঞ্চলিক এনআইডি উইংগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তারা ব্যক্তির ছবিসহ আনুষঙ্গিক তথ্য সরাসরি জাতীয় সার্ভারে আপলোড করার এখতিয়ার রাখে মাত্র, সরাসরি সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না। শুধুই ঢাকার কেন্দ্রীয় সচিবালয়ই তা পারে। তাই এটা অনুমেয়, যে ৪৭টি ভুয়া এনআইডি চট্টগ্রামে ঘটনাচক্রে উদ্‌ঘাটিত হলো, তার দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সার্ভারের নিয়ন্ত্রকদের ওপরও বর্তাবে। ঢাকা থেকে একটি তদন্ত দল চট্টগ্রামে যাচ্ছে, সেটা চট্টগ্রামের জেলা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারা বলেছেন। আমরা মনে করি, এ ঘটনার গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় এর রহস্যভেদ জরুরি। 

রোহিঙ্গাদের অনেকেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেতে আগ্রহী। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি লক্ষণীয় এবং এমন কানাঘুষা অনেকেরই জানা। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যাঁরা বাংলাদেশের এনআইডি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন, তাঁদের আশু লক্ষ্য সম্ভবত পাসপোর্ট পাওয়া। কারণ, কারও এনআইডি থাকলে পাসপোর্ট সংগ্রহ করার পথ সুগম হয়। সুতরাং এ ঘটনা আমাদের পাসপোর্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের জন্যও একটি বাড়তি সতর্কবার্তা বয়ে এনেছে। 

রোহিঙ্গা নারী রমজান বিবি লাকী নামের এনআইডি করেছিলেন। তিনি স্মার্ট কার্ড তুলতে গিয়ে সতর্ক কর্মকর্তাদের মনোযোগে আসেন। সেই সূত্রেই তদন্ত এবং আরও ৪৬টি ভুয়া এনআইডির খোঁজ মেলে। সার্ভার জালিয়াতির ঘটনায় উচ্চমানের কারিগরি দিক যুক্ত থাকার কারণে এর উপযুক্ত তদন্ত কিন্তু সহজ বিষয় নয়। এ পর্যন্ত দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে সরকারের অন্যান্য আইটি সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে কারও অংশগ্রহণের তথ্য আমরা দেখিনি।

 নির্বাচন কমিশন শুধু নয়, গোটা সরকারি প্রশাসনকে রোহিঙ্গাদের এনআইডি নেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বলেছেন, ৪৬টি ভুয়া এনআইডির বাইরে আরও থাকতে পারে। সংঘবদ্ধ একটি চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা এটি করতে পারে। তবে প্রথমেই যে প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে তা হলো সরকারি প্রশাসনে যাঁরা সার্ভার রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাঁদের যোগসাজশ ছাড়া এটা হতে পারে কি না। শুধু নির্বাচন কমিশনের লোক দিয়ে তদন্ত করানো হলে যেহেতু স্বার্থের সংঘাত ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, তা বাইরের কারও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দূর করা যেতে পারে। 

নির্বাচন কমিশন ও সরকারের উচিত হবে বিষয়টিকে শুধু রোহিঙ্গাকেন্দ্রিকভাবে না দেখে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির নিরিখে দেখা। প্রয়োজনে এনআইডি সরবরাহ এবং এ-সংক্রান্ত তথ্য রক্ষণাবেক্ষণের প্রচলিত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। একটি বিষয় অন্তত স্পষ্ট যে এনআইডি তৈরি ও বিতরণব্যবস্থা শতভাগ নিশ্ছিদ্র নয়। যাঁরা এর দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা যে যথেষ্ট সংবেদনশীল ও সতর্ক ছিলেন এমন প্রমাণ মেলে না। 

রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে একটি নতুন উদ্যোগের কথা ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যাঁরা নতুন ভোটার হবেন, তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত তথ্য রোহিঙ্গা সার্ভারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। তবে এ উদ্যোগের পাশাপাশি যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারের নিরাপত্তাকে শতভাগ নিশ্ছিদ্র করা। ফলে এনআইডি ব্যবস্থাপনার একটি সামগ্রিক মূল্যায়ন জরুরি। একই সঙ্গে আমরা আশা করব ভুয়া এনআইডিবিষয়ক তদন্তের ফলাফল প্রকাশে কোনো লুকোচুরি ঘটবে না।