বেকার তরুণেরা দক্ষ জনশক্তি হয়ে উঠুক

গ্রামাঞ্চলে বেকারত্ব

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপের ফল বলছে, দেশের গ্রামাঞ্চলে প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ তরুণ-তরুণী আছেন, যাঁরা কাজ খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। সংখ্যাটি নেহাত কম নয়, জনশক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে এর মোট উৎপাদনক্ষমতা জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান যোগ করতে পারে। কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাবে এই তরুণ-তরুণীদের জীবনের সবচেয়ে উৎপাদনশীল বয়সেই বেকার থাকতে হচ্ছে। এটা তাঁদের জন্য দুঃখ ও হতাশার বিষয়; তাঁরা নিজেদের পরিবারের কাঁধে অর্থনৈতিক চাপের বোঝা ভেবে দুঃখ পান ও গ্লানিতে ভোগেন। এটা জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় লোকসানের বিষয়ও বটে।

এই তরুণ-তরুণীরা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি চাইছেন—এটা তবু আশার কথা। কেননা, চেষ্টা করতে থাকলে একটা সময়ে কোনো না কোনো কাজ জুটে যায়। বড় সমস্যা হলো, বিবিএসের জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখন ৬২ লাখের বেশি মানুষ আছে, যারা কোনো কাজ করে না এবং করতে চায়ও না। তাদের কোনো পড়াশোনা নেই, কোনো কাজের প্রশিক্ষণও নেই। এই ৬২ লাখের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। অর্থাৎ বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেতে কাজ খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না, এমন তরুণ-তরুণীর চেয়ে বেকারত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছেন না, এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা এখন বেশি। পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ থাকায় তাঁদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার পথ প্রায় রুদ্ধ। এই বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী অর্থনৈতিকভাবে নিঃসন্দেহে নিজ নিজ পরিবারের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর কর্মক্ষম ব্যক্তিদের ওপর আর্থিক চাপ বেশি এবং পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান খারাপ হওয়ার কথা। তা ছাড়া, এই তরুণ-তরুণীদের মাদকাসক্তি ও অন্যান্য অপরাধবৃত্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।

বিবিএসের হিসাবে গ্রামাঞ্চলে মোট বেকারের সংখ্যা এখন প্রায় ৭৭ লাখ। গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রায় পৌনে এক কোটি মানুষের বেকারত্বের প্রভাবগুলো কী, তা নিয়ে বড় আকারের গবেষণা হওয়া উচিত। অবশ্য গবেষণা ছাড়াই যে কয়েকটি বিষয়কে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের বেকারত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে, সেসবের মধ্যে অবশ্যই নানা ধরনের অপরাধবৃত্তি রয়েছে। বিশেষত, যৌতুকের দাবিতে নারী নির্যাতনের উচ্চ হার। গ্রামাঞ্চলে বখাটেপনা বৃদ্ধি, স্কুল-কলেজের মেয়েদের ইভ টিজিংসহ নারীর প্রতি নানা ধরনের যৌন আক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধির সঙ্গেও গ্রামাঞ্চলের বেকার তরুণদের সম্পর্ক থাকতে পারে। গ্রামাঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ার পর মেয়েদের ওপর যে সাইবার নিগ্রহ শুরু হয়েছে এবং ক্রমে বাড়ছে, তার সঙ্গেও গ্রামাঞ্চলের বেকারত্বের সম্পর্ক উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

গ্রামাঞ্চলের বেকারত্বের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও জনমিতিক প্রভাবও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। গ্রামীণ শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে—এর অর্থ আমাদের জাতীয় উন্নয়ন এমন ঘটছে, যার ফলে কর্মসংস্থানের সমস্যা দূর হওয়ার পরিবর্তে আরও প্রকট হচ্ছে। কৃষিকাজে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খেতখামারে কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে এবং সামনের দিনগুলোতে আরও কমে যাবে।

বাংলাদেশের শহর ও গ্রাম উভয় অঞ্চলেই বেকারত্ব একটি বড় জাতীয় সমস্যা। শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। কিন্তু দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির চিত্র বেশ হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত আছে; প্রতিবছর গড়ে ১৮ থেকে ২০ লাখ নতুন মানুষ মোট জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে। সুতরাং পর্যাপ্ত শ্রমশক্তির সদ্ব্যবহার ক্রমেই বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন। বিশ্বের শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমশক্তির চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থার বহুমুখীকরণ, বিপণন ও বাজারব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমেও সেবা খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।