বরং রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার প্রস্তুতি নিন

গরুর মাংস আমদানি

যেকোনো বর্ধনশীল শিল্পের সুরক্ষা দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত নীতি। কিন্তু গরু-ছাগলে এবং তার মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও মাংস আমদানির সিদ্ধান্ত কী করে বিবেচনাধীন হতে পারে, তা বিস্ময়কর। সংসদীয় গণতন্ত্রে কালেকটিভ রেসপনসিবিলিটি বলে একটা কথা আছে। প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী স্পষ্টতই আমদানির বিরোধী। এটা ব্যক্তিগত অবস্থান হতে পারে না। ধরে নিতে হবে এটাই মন্ত্রিসভার সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত। তা ছাড়া, আমদানির অনুকূলে এই মুহূর্তে কোনো যুক্তি নেই।

পোশাকের বদলে সস্তায় মাংস বিক্রির যে প্রস্তাব ব্রাজিলের তরফে এসেছে, সে বিষয়ে বাণিজ্যসচিব ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন; এটা দুর্ভাগ্যজনক। কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই বাণিজ্যসচিব কী করে বলেন যে ‘এতে দুই দেশেরই লাভ হবে’। জাতীয় স্বার্থকে কীভাবে সুরক্ষা দিতে হয়, সে ব্যাপারে ব্রাজিলের প্রস্তাব থেকে বরং বাণিজ্যসচিব শিক্ষা নিতে পারতেন। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ মাংস আমদানির বিষয়ে কী মনোভাব রাখে, তা নিয়ে সংগঠনটির সভাপতি লুকোছাপা করেননি। তিনি বলেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘অনুরোধে’ তাঁরা এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছেন। তবে তিনি এ–ও বলেছেন, মাংস আমদানির ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিষয় বিবেচনায় থাকলে তা দেখার দায়িত্ব সরকারের।

 যে খাতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেই খাতে আমদানির সুযোগ থাকলে দেশীয় উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা স্বাভাবিক। এটা খুবই প্রশংসনীয় যে মাত্র কয়েক বছর হলো বাংলাদেশ গবাদিপশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে এবং এই সাফল্যের পেছনে সরকারের কৃতিত্ব রয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এই সাফল্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এখন হঠাৎ করে কী কারণে গরুর মাংস আমদানি করতে হবে, তা বোধগম্য নয়।

 গরুর মাংসের চাহিদার জোগান দেওয়ার সামর্থ্য যেহেতু দেশের খামারিদের রয়েছে, তাই গরুর মাংস আমদানির যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের গবাদিপশু শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জায়গা থেকে মাংস আমদানিকে না বলতেই হবে। খুব বেশি দিন হয়নি বাংলাদেশ গবাদিপশু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে পরিণত হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে এই খাতের অবদানের মাত্রা অনুমান করা যাবে এই খাতে বিনিয়োগ এবং এর সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে। বর্তমানে এই খাতে লগ্নি করা অর্থের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে যুক্ত। এমন একটি শিল্প কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক বা এর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হোক, তা প্রত্যাশিত নয়। এই খাত অনেক তরুণ উদ্যোক্তাকে আয়–রোজগারের পথ দেখিয়েছে এবং তাঁদের স্বাবলম্বী করেছে। তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।

আমরা মনে করি, এই খাতকে কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সেটাই এখন গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আমদানিকারক নয়, বাংলাদেশ কীভাবে এই খাতের রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হতে পারে, সেই লক্ষ্যেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত। কৃষিনির্ভর এই দেশে গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধি ও এই খাতের উন্নয়ন বাড়তি সুফল দেবে। কারণ, এর সঙ্গে জৈব সার এবং পরিবেশের কথা যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে গবাদিপশুর অধিকতর উন্নয়ন কৃষিজমিকে উর্বর এবং দুধের চাহিদা পূরণের একটি বিরাট উৎস হিসেবে গণ্য হবে। পুষ্টির ঘাটতি মেটানো আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। গবাদিপশু খাতের বিকাশ আমাদের দুগ্ধশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিদেশ থেকে মাংস আমদানির বিষয়টিকে আমরা আত্মঘাতী বলে মনে করি। আশা করছি, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এই অবস্থান থেকে সরে আসবেন।