ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে, যা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। একদা যেসব দরিদ্র নারী চার দেয়ালের ভেতরে বন্দী ছিলেন, তাঁরাও ক্ষুদ্রঋণের সুবাদে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন। এই ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশের জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বয়ে এনেছে। এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের খবর। কিন্তু এসব আনন্দের আড়ালে গভীর বেদনাও লুকিয়ে আছে। এনজিও নামে পরিচিত ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থাগুলো যেভাবে উন্নতি করেছে, সেভাবে ঋণগ্রহীতাদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। একসময় ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থাগুলো ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হারে সুদ নিত। কোনো নিয়মনীতির বালাই ছিল না। এ অবস্থার অবসান এবং বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে অধিকতর স্বচ্ছতা কার্যকর করতে ২০০৬ সালে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। অতীতে ক্ষুদ্রঋণের উচ্চ সুদের হার নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার ২০১০ সালে সুদের হার ২৭ শতাংশ বেঁধে দেয়। একই সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সুদের হার আরও কমিয়ে আনার কথাও বলা হলেছিল। কিন্তু গত ১০ বছরে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের শর্ত পূরণের জন্য এনজিওগুলোর পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ৩ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত ১৯ জুন এমআরএ পরিচালনা বোর্ডের সভায় কমিটির সুপারিশের আলোকে এনজিও ঋণের সুদের হার ২৪ শতাংশের পুনর্নির্ধারণ করা হয় এবং তা সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়। এমআরএর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৬৯৯টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। ১০ লাখের বেশি ঋণগ্রহীতা রয়েছে ব্র্যাক ও আশার। ১ লাখ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত ঋণদাতা সংস্থার সংখ্যা ২৬টি।
ক্ষুদ্রঋণের উল্লেখযোগ্য অংশের জোগানদার পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। এই সংস্থা থেকে এনজিওগুলো মাত্র ৪-৬ শতাংশ হারে ঋণ পেয়ে থাকে। অতএব, ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার কোনোভাবে ২০ শতাংশের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। ক্ষুদ্রঋণের বর্ধিত সুদের হারের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলা হয়, ব্যাংকব্যবস্থায় গ্রাহক ব্যাংকের কাছে যান আর ক্ষুদ্রঋণদাতা গ্রহীতাদের কাছে যান। ফলে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় অনেক বেশি। কিন্তু গত দুই দশকে যোগাযোগব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় আগের চেয়ে অনেক কমে যাওয়ার কথা। সুতরাং তারা ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার অবশ্যই আরও কমাতে পারে।
আমরা ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। ব্যাংকব্যবস্থায়ও সুদের হার কমেছে। কোনো কোনো মহল ঋণদাতা সংস্থাগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, তা অমূলক। ঋণের সুদের হারের কারণে কোনো সংস্থা দেউলিয়া হয়েছে, এ রকম প্রমাণ নেই। বরং ঋণদান সংস্থাগুলোর সম্পদ ও জৌলুশ উত্তরোত্তর বেড়েছে। অনেক এনজিওর নির্বাহীরা পাজেরো নিয়ে ঘুরে বেড়ান। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতারা, যাঁরা দরিদ্র মানুষ, তাঁরা বিভিন্ন এনজিও ঋণের চক্রে বন্দী হয়ে আছেন। তাঁরা একটি সংস্থার ঋণ শোধ করতে অন্য এক বা একাধিক সংস্থার শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন। এই ঋণচক্র থেকে দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের বের করে আনতে সুদের হার কমানোর বিকল্প নেই। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত যাতে সব ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থা মেনে চলে, তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের নামে দেশে নতুন মহাজনিব্যবস্থা কাম্য নয়। ঋণদান সংস্থাগুলোকে সত্যিকারভাবেই দরিদ্র–সহায়ক হতে হবে।