ক্ষতি পোষাতে টেকসই পদক্ষেপ প্রয়োজন

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

গত মঙ্গলবার ইউনিসেফ ও ইউনেসকো প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের শিশুশিক্ষার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কোভিড-১৯-এর প্রভাব মোকাবিলা কার্যক্রমবিষয়ক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বলা হয়, ২০২০ সালের প্রথম দিকে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। শিশুদের পড়াশোনার ওপর মহামারির অব্যাহত প্রভাব এবং তা মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের সরকারের গৃহীত কর্মসূচি ও উদ্যোগের কথাও তুলে ধরা হয় এ প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদন উত্থাপনকালে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ইউনিসেফের পরিচালক মার্কোলুইজি কোরসি যথার্থই বলেছেন, যখন স্কুল বন্ধ থাকে, তখন শিশুরা শেখার ও বেড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় সুযোগ হারায়। পুরো একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদে বিদ্যালয়গুলো পুনরায় চালু করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

ইউনিসেফের সহায়তায় ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন (সিএএমপিই) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকার সময়ে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতি তিনজন শিক্ষার্থীর মধ্যে দুজনের কাছে দূরশিক্ষণসেবা পৌঁছানো যায়নি। এর অর্থ দুই–তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষার সুযোগ পায়নি। বস্তুগত সম্পদ ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সহায়তার অভাবের কারণে এটি হয়েছে। ইউনিসেফ ও ইউনেসকো মনে করে, এশিয়া যদি আগামী ৯ বছরে জাতিসংঘের ২০৩০ সালের অ্যাজেন্ডার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার শিক্ষাবিষয়ক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, তাহলে এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা বাজেট গড়ে ১০ শতাংশ বাড়াতে হবে।

স্বীকার করতে হবে যে করোনায় অন্যান্য খাত থেকে শিক্ষার ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি ও সুদূরপ্রসারী। আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের যেসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় ছেদ পড়েছে, তাদের আবার শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। বিদ্যালয়গামী অনেক কন্যাশিশুর বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেরা পরিবারকে সহায়তার জন্য কাজে যেতে বাধ্য হয়েছে। সরকারের প্রধান কর্তব্য হবে এসব শিশুকে ফের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে সঠিক তালিকা করে এসব পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা দিতে হবে; যাতে করে তারা সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারে। এর পাশাপাশি দূরশিক্ষণ বা অনলাইন শিক্ষার সেবাও সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে। করোনা কবে শেষ হবে, কেউ বলতে পারছে না। অতএব, আমাদের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।

এ ক্ষেত্রে ইউনিসেফ ও ইউনেসকোর আধিকারিকেরা যে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার ও বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে বলেছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। সরকারের একার পক্ষে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। আমরা শিক্ষার প্রসার নিয়ে যতই বড়াই করি না কেন, এখনো আমাদের শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার উন্নয়ন মানে বড় বড় ভবন তৈরি নয়, শিক্ষার উন্নয়ন হলো প্রত্যেক শিশুকে শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় এনে তাকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। করোনাকালে শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে এবং সব শিশুর জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই।