গতকাল মঙ্গলবারের সংবাদমাধ্যম ছিল নানা ধরনের নৃশংস অপরাধের খবরে আকীর্ণ। রাজধানীর এক উড়ালসড়কে ভাড়ায় চালিত একটি মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের জন্য চলন্ত অবস্থায় সেটার চালকের গলায় ছুরি চালিয়েছে তাঁর পেছনে বসা যাত্রী—এমন বেপরোয়া নিষ্ঠুরতার ব্যাখ্যা কী? এই দেশে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, এমনকি ট্রাকও ছিনতাই হয়; কিন্তু সে জন্য খুনের ঘটনা খুবই কম ঘটে থাকে। সে তুলনায় কম অর্থমূল্যের বাহন একটি মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নিতে তার চালকের গলায় ছুরি চালানো? এমন অবলীলায় মানুষ খুন করা? অপরাধপ্রবণ মন এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠার কী কারণ থাকতে পারে?
একই দিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত আরেকটি খবরে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামে নবম শ্রেণির ছাত্র এক কিশোর প্রতিবেশী দম্পতির ৯ বছর বয়সী মেয়েকে ধর্ষণের পর খুন করে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছে তার লাশ। নেত্রকোনায় এক কলেজছাত্রীকে তারই এক সহপাঠী ধর্ষণের পর হত্যা করেছে, এই অভিযোগে মামলা হয়েছে। সুনামগঞ্জের ধরমপাশায় ধর্ষণের শিকার হয়েছে মাত্র ৮ বছর বয়সী এক বাক্প্রতিবন্ধী শিশু। নোয়াখালীতে ধর্ষণের শিকার এক নারীর স্বামী বিচার চাইতে মামলা করেছেন বলে তাঁর গায়ে অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে। ঢাকার নবাবগঞ্জে দুর্বৃত্তরা এক নারীকে হত্যা করে লাশ রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে গেছে। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে খুন হয়েছেন এক পুলিশ সদস্যের স্ত্রী। মানিকগঞ্জ সদর থানায় পুলিশ উদ্ধার করেছে এক প্রবাসীর স্ত্রীর লাশ। রাজবাড়ীতে এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করার অভিযোগে মামলা হয়েছে এক মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। নারায়ণগঞ্জে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন পুলিশের এক সদস্য।
এগুলো শুধু প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক দিনের সংবাদ। অন্যান্য সংবাদপত্র ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমেও এ ধরনের অপরাধের খবর প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, হত্যা, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার খবরগুলোই মূলত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আরও অনেক ধরনের অপরাধ প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে, সেগুলোর খবর অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের দেশে অপরাধবৃত্তি এতটাই বেড়ে গেছে যে খুন-ধর্ষণের ঘটনা না ঘটলে সেগুলো যেন খবর বলে গণ্য হচ্ছে না। অপরাধ বৃদ্ধির এই ধারা বিরাট উদ্বেগের বিষয়। কারণ, এভাবে সমাজের স্বাভাবিক শান্তিশৃঙ্খলা অনিশ্চয়তার দিকে যায় এবং জনমনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে ওঠে; শান্তিশৃঙ্খলা ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ও বাহিনীগুলোর ওপর জনসাধারণের আস্থা কমে যায়।
বাংলাদেশে খুন, ধর্ষণসহ সহিংস ও গুরুতর অপরাধের বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর আইন বলবৎ আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমনের জন্য আমাদের বিশাল পুলিশ বাহিনী আছে, অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য আছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ অত্যন্ত শক্তিশালী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আছে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। কিন্তু সবকিছু থাকা সত্ত্বেও খুন-ধর্ষণসহ গুরুতর অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা ক্রমে বেড়েই চলেছে। শুধু তা-ই নয়, কখনো কখনো কোনো কোনো নৃশংস অপরাধের ঘটনায় অপরাধীদের দুঃসাহসের দৃষ্টান্তে প্রতীয়মান হচ্ছে, অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরা খুন-ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধগুলো অবলীলায় করে ফেলার মতো সহজ ব্যাপার বলে মনে করছে। তাদের মনে এমন অভয় সৃষ্টি হয়েছে যে খুন-ধর্ষণ করেও আইন-বিচার-শাস্তির ঊর্ধ্বে থাকা যাবে। এর প্রধান কারণ, অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকর হওয়ার দৃষ্টান্ত মোট সংঘটিত অপরাধের সংখ্যার তুলনায় খুবই কম।
বিচারহীনতার এই পরিবেশ যেকোনো রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য যারপরনাই উদ্বেগজনক। দ্রুত এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উদ্যোগ নিতে হবে। সে জন্য প্রথমত আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব সম্পূর্ণভাবে দূর করতে হবে, দ্বিতীয়ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সততা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।