রাষ্ট্র হোক কৃষকের মূল আশ্রয়স্থল

কৃষিঋণের উৎস

বাংলার কৃষকের সঙ্গে আমরা এতকাল কী আচরণ করেছি, তার একটা আশু মূল্যায়ন দরকার। কৃষক খেতে আগুন দেওয়ার পরে আমরা কেউ কেউ তাঁদের ধান কেটে সহায়তা দিতে গিয়েছি। কিন্তু যারা নাগরিকের ভাগ্যনিয়ন্তা, সেই শ্রেণি যথারীতি নীরবতা পালন করেছে।

আমরা কমবেশি অনেকেই কৃষক সমাজের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে অন্যায় ও অন্যায্য আচরণ করে চলেছি। আমরা একটা দীর্ঘ সময় বাম্পার ফলনের আনন্দে বিভোর থেকেছি। চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সবজি উৎপাদন বৃদ্ধিতে পঞ্চম ও ফল উৎপাদন বৃদ্ধিতেপ্রথমহওয়া নিয়ে গৌরবান্বিত হয়েছি। কিন্তু যা আমাদের সবার পাপ, সেটা হলো ওই সব সাফল্যের যাঁরা রূপকার, সেই কৃষকের সত্যিকারের জীবনমান উন্নয়নে, বিশেষ করে গত এক দশকে কী সাফল্য এসেছে, সেদিকে আমরা যথেষ্ট মনোযোগ দিইনি।

এখন আমরা খুব অবাক না হয়ে আকস্মিকভাবে ইফপ্রি সমীক্ষা থেকে জানলাম, শোষিত মানুষের মুক্তির মন্ত্রে যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, আর শোষিতের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা যে কৃষকশ্রেণি, তার জীবনেই রাষ্ট্র সব থেকে নিষ্ক্রিয় শক্তি। এটা সত্য যে গত ১০ বছরের ব্যবধানে অতীতের তুলনায় কৃষি উপকরণ সহজলভ্য হয়েছে। বিশেষ করে সুষম সেচ ও সার সরবরাহব্যবস্থার কারণে চাষাবাদের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটেছে। এর ফলে বাংলাদেশের আবাদি জমি ব্যবহারের বৈচিত্র্য বেড়েছে। এসবই কৃষির নানা শাখায় বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানের সাফল্য।

আমরা যখন নির্বাচনী ইশতেহারে কিংবা জনসভাগুলোতে কেজিপ্রতি চাল ১০ টাকা কিংবা পারলে তার থেকে কমে কিনতে পারার আশ্বাস পেয়েছি, তখন আমরা তাতে পুলকিত হয়েছি। জীবনধারণের অন্য সব অনুষঙ্গের দাম যত খুশি বাড়ুক আমরা বিচলিত হই না, আমাদের, মধ্যবিত্তের সুখনিদ্রায় তাতে ব্যাঘাত ঘটে না। কিন্তু যখনই চাল বা নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজির দাম বাড়ে, আমাদের ব্রহ্মতালুতে মুহূর্তেই উষ্ণ প্রস্রবণ বয়ে যায়। আমাদের খাদ্যনীতিতে কখনো উচ্চ ফলন কী করে কৃষকের জীবনে অভিঘাত ফেলেছে, আমরা তা নির্মোহভাবে ঠান্ডা মাথায় খতিয়ে দেখতে রাজি হইনি। কিন্তু এবার খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থাটি যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা ভয়াবহ।

এই রাষ্ট্র পদ্ধতিগতভাবে কী করে কৃষক ও তাঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে বৃহত্তম জনগোষ্ঠীকে কম দামে খাদ্যশস্য নিশ্চিত করেছে, প্রকৃতপক্ষে তারই একটি সালতামামি তৈরি হয়েছে ইফপ্রিতে। কৃষকের খাদ্যশস্যঋণের মূল জোগানদাতা এনজিও। দ্বিতীয় ও তৃতীয় উৎস হলো জমি বন্ধক এবং আত্মীয় বা বন্ধু। চতুর্থ উৎসটি তাঁকে বেঁধে চাবুক মারার মতো একটি বিকল্প। কারণ, অনধিক ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ঋণ নিয়ে কৃষক রাষ্ট্রীয় জমিজিরাতের স্বাভাবিক জীবনচক্রকে বাঁচিয়ে রাখেন। খাদ্যশস্যের সুফলন এবং তার স্থিতির ওপর অনেক সময় সরকারগুলোর ভাগ্য এবং তাদের জনপ্রিয়তার ওঠানামা জড়িয়ে থাকে। অথচ রাষ্ট্র তার দুঃসময়ে সব থেকে নির্জীব এবং ভাবলেশহীন শক্তি হিসেবেই পাশে থাকে। আমরা এটা জেনে স্তম্ভিত যে কৃষিঋণের মাত্র ৬ শতাংশের জোগানদাতা হলো রাষ্ট্রীয় কৃষিব্যাংক। দেশের বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখানে কৃষক বংশপরম্পরায় মহাজনের ক্রীড়নক, আজ তাঁদের হটাতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ লাগবে।

এ অবস্থা থেকে বেরোতে আসন্ন বাজেটে পরিবর্তিত খাদ্যনীতি চাই। যার মূল লক্ষ্য থাকবে কৃষক যা–ই ফলাবেন, উৎপাদন খরচ কমিয়ে তাঁকে ন্যায্যমূল্য দেওয়ার পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষক বাঁচাতে বাজারমুখী নীতির জিগির বন্ধ করতে হবে। কৃষিঋণের পরিধি বাড়ানো, সুদ মওকুফ বা পুনঃ তফসিলীকরণে এখনই ঘোষণা চাই। গত কয়েকটি বাজেটে কৃষিঋণে কোনো বরাদ্দ ছিল না, পাঁচ হাজার কোটি টাকার জলবায়ু তহবিলের মতো একটি বৃহৎ বরাদ্দ চাই।