গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের চারটি অংশের মোট প্রায় ১০ হাজার বন্দীর চিকিৎসার জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক নিযুক্ত আছেন—শনিবারের প্রথম আলোয় প্রকাশিত এই খবর থেকে মনে হতে পারে, কারাগার কর্তৃপক্ষ বা সরকার হয়তো ধরে নিয়েছে যে কারাবন্দীদের তেমন অসুখ-বিসুখ হয় না। তবে এমন ধারণা যে ঠিক নয়, তা আমরা বুঝতে পারলাম ওই কারাগারের দুটি অংশের তত্ত্বাবধায়ক মো. শাহজাহানের বক্তব্য থেকে। তিনি প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘বন্দীদের চিকিৎসা দেওয়া আমাদের মৌলিক দায়িত্ব।’
কিন্তু কোনো রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব সম্পর্কে তার কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তার সচেতনতা বা স্বীকারোক্তি যথেষ্ট নয়; সরকারের নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের দায়িত্ববোধ ও আন্তরিক তাগিদও প্রয়োজন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ২ নম্বর অংশে ২০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে চিকিৎসকের ৩২টি পদও সৃষ্টি করা হয়েছে, কিন্তু কোনো চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়নি। গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মাত্র একজন চিকিৎসককে প্রেষণে পাঠানো হয়েছে। কারাগারের চারটি অংশের প্রতিটিতে একটি করে ২০ শয্যার হাসপাতাল আছে, কিন্তু সেগুলোর কোনোটিতেই কোনো চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়নি। তাহলে প্রায় ১০ হাজার কারাবন্দীর চিকিৎসা কীভাবে চলছে, এই প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাওয়া যাবে?
কার্যত কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থাই তাঁদের জন্য নেই। প্রেষণে নিযুক্ত একমাত্র চিকিৎসককে প্রতিদিন ৫০-৬০ জন রোগী দেখতে হয়, তাঁদের মধ্যে যাঁদের অবস্থা গুরুতর হয়ে ওঠে, তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় গাজীপুর কিংবা ঢাকার কোনো হাসপাতালে। তাঁদের ভাগ্য ভালো যে চারটি হাসপাতালের জন্য চারটি অ্যাম্বুলেন্স আছে।
কারাগার কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী বন্দীরা যক্ষ্মা, টাইফয়েড, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন। যথাসময়ে চিকিৎসা না পাওয়া হৃদ্রোগীদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ; মাঝেমধ্যে যেসব কারাবন্দীর মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাঁদের অধিকাংশই মারা যান হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে। যক্ষ্মা, টাইফয়েড, চর্মরোগ ইত্যাদি সংক্রামক ব্যাধিও কারাবন্দীদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি কারাবন্দীকে যে পরিবেশে বাস করতে হয়, তা স্বাস্থ্যকর নয়। সেখানে ছোঁয়াচে সংক্রামক ব্যাধিগুলো একসঙ্গে অনেক বন্দীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। এই অবস্থায় চিকিৎসার অভাবে কোনো বন্দীর মৃত্যু হলে তার দায় কারা কর্তৃপক্ষের ওপরই বর্তায়। উল্লেখ্য, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মহিলা অংশে ৮৩০ জন নারী বন্দী আছেন, তাঁদের সঙ্গে আছে ৫৪টি শিশু। চিকিৎসক ও চিকিৎসাহীন অবস্থায় কারাগারের নোংরা, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসহীন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাঁদের স্বাস্থ্যগত নাজুকতার প্রতি উদাসীনতা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসাব্যবস্থার এই প্রায় অনুপস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অবিলম্বে চিকিৎসকদের শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হোক। প্রয়োজনীয়সংখ্যক নার্স ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করে কারাবন্দীদের ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হোক।