সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা জরুরি

কার ভাতা কে পায়

করোনাকালে গত জুনে যখন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি বরাদ্দ ঘোষণা করেন, তখন স্বাভাবিক কারণে দেশবাসী স্বস্তিবোধ করেছিল। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ছিল ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। এটি প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও আশা করা গিয়েছিল, প্রান্তিক মানুষের করোনার ধকল কাটাতে এ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কিন্তু অর্থবছরের আড়াই মাসের মাথায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির হালফিল সম্পর্কে গবেষকেরা যেসব তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরেছেন এবং গণমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দুস্থ, বৃদ্ধ ও বিধবা ভাতা দেওয়া হয়। এ ছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে কাবিখা, কাবিটা ছাড়াও ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রির কর্মসূচি আছে। এর বাইরে চলতি বছর ৫০ লাখ পরিবারকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে এককালীন সহায়তা দেওয়ারও কর্মসূচি নেওয়া হয়।

শেষোক্ত কর্মসূচির অর্থ বিতরণ নিয়ে যে ব্যাপক নয়ছয় হয়েছে, তা প্রথম আলোর একাধিক প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে। প্রথম দফায় তালিকাভুক্ত ৫০ লাখ লোকের মধ্যে ৩৪ হাজারকে শনাক্ত করা হয়, যাঁরা ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার যোগ্য নন। দ্বিতীয় দফায় যাচাই–বাছাই করে ৩৬ লাখ লোকের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। বাকি ১৬ লাখ সহায়তার বাইরেই থেকে যান তালিকায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও কারিগরি ত্রুটির কারণে। নতুন কোনো অভাবী ও ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য লোককে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), অক্সফাম ইন বাংলাদেশ ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক কমিটির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত গত বুধবার ভার্চ্যুয়াল সংলাপেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির নানা অনিয়ম ও অসংগতি বেরিয়ে আসে। বক্তাদের মতে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়লেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। অন্যদিকে যা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা–ও উদ্দিষ্ট মানুষের কাছে পৌঁছায় না।

অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনা, পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দপ্রাপ্তদের ১৯-২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র নয়। এর অর্থ সহায়তা কর্মসূচির এক–পঞ্চমাংশ পাচ্ছেন সচ্ছল ব্যক্তিরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও বলেছিলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রধান সমস্যা হলো এটি যাঁদের জন্য করা, তাঁরা পান না। আবার বিতরণ–প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অপচয় হয়।

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি ও বরাদ্দ বেড়েছে, এটি আশার কথা। কিন্তু যাঁদের জন্য এ কর্মসূচি, তঁাদের হাতে না পৌঁছালে বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ কী। বেসরকারি কোনো গবেষণাকে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সাধারণত বাঁকা চোখে দেখেন। তবে এ সংলাপে জাতীয় সংসদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এ বি তাজুল ইসলাম বলেছেন, এ গবেষণা থেকে সরকার ও অংশীজনেরা লাভবান হবে। কিন্তু আমাদের নির্বাহী বিভাগ জাতীয় সংসদ ও সাংসদদের কথাকে খুব আমলে নেয়, এমন প্রমাণ নেই।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে সফল করতে হলে কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারি কর্মকর্তারা মনগড়া তালিকা তৈরি করতে পারবেন না। সমাজের প্রান্তিক মানুষের জন্য যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়, তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক।