করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং এ রোগে মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিন। সংক্রমণের উল্লম্ফন বিস্ময়কর ও উদ্বেগজনক। সংক্রমণের ১২তম মাসের তুলনায় পরের মাসে সংক্রমণ বেড়েছে ৭৪৪ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ২৮০ শতাংশ। সংক্রমণের এ হিসাব অবশ্যই আংশিক। এটা শুধু পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত সংক্রমণের হিসাব। উপসর্গহীন সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা কত, তা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংক্রমিত মানুষের মোট সংখ্যা ও দৈনিক সংক্রমণের হার অনেক বেশি। আইইডিসিআর বলছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৬টিই এখন সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। সংক্রমণরেখা ওপরের দিকে উঠছে খাড়াভাবে; আর কথিত লকডাউনের যে শিথিলতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে সংক্রমণ বৃদ্ধির এ প্রবণতা আরও কত দিন অব্যাহত থাকবে, তা বলা অত্যন্ত কঠিন।
কিন্তু সংক্রমণরেখার এ উল্লম্ফনের কারণ কী? অনেক কারণের একটি হলো এই যে বাংলাদেশে এখন আফ্রিকান ধরন বা ভেরিয়েন্টের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সর্বাধিক। আইসিডিডিআরবি, আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ গবেষণায় গত ১৮ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত যেসব মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত বলে শনাক্ত হয়েছেন, তাঁদের ৮১ শতাংশই সংক্রমিত হয়েছেন আফ্রিকান ধরনের করোনাভাইরাসে। ভাইরাসের এ ধরনের সংক্রমণক্ষমতা অন্য ধরনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। এর চেয়ে গুরুতর সমস্যার কথা হলো, এ ধরনের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের জন্য উদ্ভাবিত টিকাগুলো যথেষ্ট কার্যকর নয়। বিশেষত আমাদের দেশে অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেটির কার্যকারিতা কম, এমন কথা বিভিন্ন গবেষণা সমীক্ষার সূত্রে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য থেকে ছড়িয়ে পড়া আরেক ধরনের করোনাভাইরাসেও এখন বাংলাদেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ধরনের সংক্রমণক্ষমতাও অত্যন্ত বেশি।
এ উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে দেশের হাসপাতালগুলোয় কোভিড রোগীর চাপ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে এবং প্রতিদিনই আরও বাড়ছে; বিশেষত অক্সিজেন ও আইসিইউ সুবিধার অভাবে গুরুতর রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার বেশি হচ্ছে। কোভিড–১৯ রোগে মৃত্যুর হার সাধারণভাবে ৪–৫ শতাংশ বলা হয়। কিন্তু এ মুহূর্তে বাংলাদেশে মৃত্যুহার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। সুতরাং আমাদের জন্য উচ্চমাত্রার সংক্রমণ হারই শুধু সমস্যা নয়, মৃত্যুহারও গুরুতর সমস্যা। আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক বিরাট অংশ উপসর্গহীন, অনেক আক্রান্ত মানুষ বাসায় থেকে সাধারণ সিম্পটম্যাটিক চিকিৎসায়ই সেরে উঠছেন, এটা ভেবে এখন আর অভয় বোধ করার সুযোগ নেই। সংক্রমণের বিষয়ে হেলাফেলা করার উপায় নেই।
সমস্যা হলো, মারাত্মক ছোঁয়াচে যে ভাইরাস প্রতিনিয়ত নিজেকে রূপান্তর করছে, টিকার কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে, সেই শত্রুকে কার্যকরভাবে প্রতিহত করার উপায় কী?
প্রথম উপায় হলো শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি ও বজায় রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কারণ, এ ভাইরাস মানুষে মানুষে সংস্পর্শ ছাড়া ছড়াতে পারে না। তাই জনসমাগম এড়ানো, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ব্যবহার করা, ঘন ঘন হাত ধোয়া—স্বাস্থ্যবিধির এসব প্রাথমিক নিয়ম সবাইকে সর্বোচ্চ মাত্রায় মেনে চলতে হবে। দ্বিতীয় উপায় হলো টিকা গ্রহণের মাধ্যমে ভাইরাস প্রতিরোধ করা; টিকার কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য দেশে নিয়মিত করোনাভাইরাসের সব কটি ধরন বা ভেরিয়েন্টের হোল জিনোম সিকোয়েন্সিং বা জিনের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন এবং সেসবের হালনাগাদ তথ্য–উপাত্ত নিয়মিত টিকা উদ্ভাবক ও উৎপাদনকারীদের কাছে সরবরাহ করা উচিত, যাতে তারা ভাইরাসের রূপান্তরিত ধরন প্রতিরোধ করতে পারে, এমনভাবে টিকার মডেলিংও পরিবর্তন করতে পারে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে খুবই কম। অবিলম্বে এ উদ্যোগ বাড়ানো প্রয়োজন।