গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বেশ উন্নতি হয়েছে। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার অনেক হ্রাস পেয়েছে এবং ক্রমে আরও হ্রাস পাচ্ছে। প্রসূতিসেবার মান বৃদ্ধির ফলে প্রসবকালে তাঁদের মৃত্যুর ঝুঁকিও কমেছে। টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের ফলে কিছু সংক্রামক রোগ, যেমন পোলিও নির্মূল হয়েছে এবং যক্ষ্মা, কলেরা ইত্যাদি রোগে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতির কয়েকটি সূচকে ভারত, পাকিস্তানসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন লেখালেখি, বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে আমাদের এই সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন। এই সাফল্যের জন্য বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম অর্জিত হয়েছে; অনেক দেশের স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারক, গবেষক-বিশেষজ্ঞ ও ব্যবস্থাপক ও অন্যরা আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ধারণা নিতে এ দেশে আসেন।
এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সারা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কর্মরত কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের ফলে। শিশুদের টিকা দেওয়া, গর্ভকালে ও প্রসবের সময় প্রসূতি ও শিশুর সেবা, কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া; ডায়রিয়া, কলেরা, কালাজ্বর ইত্যাদি প্রতিরোধ, নির্মূল করাসহ নানা ধরনের সেবা তাঁরা দিয়ে থাকেন। দেশের জনগোষ্ঠীর একদম তৃণমূল পর্যায়ে তাঁদের আট ধরনের সেবার কার্যকারিতা ও সাফল্য বৈশ্বিক পরিসরে স্বীকৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশে তাঁদের সংখ্যা প্রায় সাত লাখ, অধিকাংশই নারী। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে এই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীদের অবদান বিরাট, কিন্তু তাঁদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কম।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী সম্মেলনে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তাঁদের অবদান নিয়েও আলোচনা হয়। বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশের প্রায় ৫০০ নীতিনির্ধারক, গবেষক, বিশেষজ্ঞ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মকর্তা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের অবদানের পাশাপাশি তাঁদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক স্বীকৃতি ইত্যাদি প্রসঙ্গও ওঠে। বাংলাদেশে এই স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কম। তাঁদের চাকরির সামাজিক মর্যাদাও যথাযথভাবে স্বীকৃত নয়। কিন্তু তাঁরা যেসব কাজে নিয়োজিত, সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের মধ্যে যেন হতাশা সৃষ্টি না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বলেও কোনো কোনো বক্তা মন্তব্য করেন।
ওই সম্মেলনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, যা সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ের কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা খাতের নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় সাফল্যের ক্ষেত্রে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা যে ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন; অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এই ক্ষেত্রেও তাঁদের বড় ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে। ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগ—এই সব অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বিশ্বজুড়েই ক্রমে বাড়ছে। এই বৃদ্ধির প্রবণতা বাংলাদেশেও বড় দুশ্চিন্তার কারণ। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বা তৃণমূল পর্যায়ে এসব রোগের সুচিকিৎসা দুর্লভ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাঁরা এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা, কমিউনিটির মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসচেতনতাবিষয়ক বার্তা পৌঁছে দেওয়া, রোগ শনাক্ত করা, রোগ ও তার চিকিৎসা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া, চিকিৎসাপ্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষায় সহায়তা করার মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারেন।
তবে তা করতে হলে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে কর্মরত কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি নয়; তাঁদের বৃহত্তর অংশই গ্রাম-মফস্বলের নারী। সুতরাং তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাই হবে প্রথম কাজ। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে কমিউনিটি স্বাস্থ্য খাতে, বিশেষত এই স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। আমরা আশা করব, সরকার এ বিষয়ে যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেবে। বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও একই পন্থা অবলম্বন করতে হবে।