সবুজ ও খোলা জায়গা বাড়ুক

কংক্রিটের শহর ঢাকা

বহু বছর আগে কংক্রিটের শহরের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ইটের পর ইট মাঝে মানুষ কীট/ নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা। এখন ঢাকা শহরে ফুল বিকাবে কী, ফুল জন্মানোর জায়গাই তো হারিয়ে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে কংক্রিটের ভবন। এসব দালানের আড়ালে ঢাকা পড়ছে আকাশও। 

এভাবে যেকোনো দেশের রাজধানী শহর গড়ে উঠতে পারে না, সেই কথাটি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানিয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স বা বিআইপি। ঢাকা শহরের ‘বায়ু, পরিবেশ ও বসবাসযোগ্যতার প্রেক্ষিত সবুজ এলাকা, জলাশয়, খোলা উদ্যান ও কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার বিদ্যমান অবস্থা’ শীর্ষক তাদের গবেষণায় যেসব চিত্র উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নগর–পরিকল্পনাবিদদের মতে, আদর্শ একটি শহরের ১০-১৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় ও ১৫-২০ শতাংশ এলাকা সবুজে আচ্ছাদিত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা শহরে গত দুই দশকে খোলা জায়গার পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। মোট ভূমির মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ খোলা জায়গা হিসেবে টিকে আছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে নয়টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ১১টি অঞ্চলে ভাগ করে এ জরিপ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আদর্শ নগরে প্রতিটি মানুষের জন্য ৯-৫০ বর্গমিটার সবুজ এলাকা প্রয়োজন। 

গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার কেন্দ্রীয় নগর এলাকায় বর্তমানে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির প্রায় ৮২ শতাংশ। ১৯৯৯ সালে কংক্রিটের আচ্ছাদন ছিল ৬৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ এলাকায়। ২০০৯ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা ২০ বছর আগে ছিল ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। 

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিআইপি কিছু সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে আছে শহরের চারপাশে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা, বিদ্যমান জলাশয় সংরক্ষণ ও দখলকৃত জলাশয় পুনরুদ্ধার, এলাকাভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক সবুজ এলাকা গড়ে তোলা; শহরের উচ্চ জনসংখ্যা, জনঘনত্ব ও কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার বিদ্যমান বাস্তবতায় শহরে নতুন করে কংক্রিটের বিস্তৃতি না ঘটানো; অবকাঠামোগত পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে পরিবেশগত, প্রতিবেশগত, সামাজিক ও অন্যান্য প্রভাব পর্যালোচনা করা; বর্ধিত নগর এলাকায় পরিকল্পনার মাধ্যমে সবুজ এলাকা ও জলাশয় এলাকা নিশ্চিত করা; স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে নগরে সবুজ, নীল ও ধূসর অবকাঠামোর সুষম ভারসাম্য নিশ্চিত করা।

ঢাকা শহরকে মোটামুটি বাসযোগ্য রাখতে চাইলেও এর প্রতিটি সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? যারা জলাভূমি ও মাঠ দখল করে কংক্রিটের ভবন বানাচ্ছে, তারা অনেক বেশি ক্ষমতাবান। তাদের দাপট দেখে কোনো ক্ষেত্রে এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সরকারের চেয়েও তারা বেশি শক্তিশালী। এ কারণেই মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে তৈরি করা ড্যাপ বা ঢাকা ডিটেইলস এরিয়া প্ল্যান ভেস্তে গেছে। ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনার ভাগ্য যে ভিন্ন হবে, তার নিশ্চয়তা কী। 

এই নিরাশার মধ্যেও আশার খবর হলো, ঢাকা শহরে সবুজে আচ্ছাদিত জায়গা কিছুটা বেড়েছে। ২০ বছর আগে যেখানে সবুজে আচ্ছাদিত এলাকা ছিল ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ, বর্তমানে সেটি ৯ দশমিক ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ছাদকৃষি বা ছাদবাগান এই হিসাবের বাইরে। সবুজ পরিবেশ সম্পর্কে এটি জনসচেতনতার প্রমাণ। 

নগর-পরিকল্পনায় বলা আছে, কোথায় কতটুকু জায়গা খোলা রাখতে হবে, কতটুকু জায়গায় ভবন নির্মাণ করা যাবে। কিন্তু আইন যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরাই যদি সেই আইন লঙ্ঘন করেন কিংবা লঙ্ঘনকারীকে প্রশ্রয় দেন, তাহলে ঢাকা কংক্রিটের জঙ্গল হতে বাধ্য। এখনো সময় আছে, ঢাকাকে বাঁচান, দখলদারদের হাত থেকে জলা ও খোলা ভূমি উদ্ধার করুন।