বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের কম সামর্থ্য এবং অদক্ষতার বিষয়টি বহু বছর ধরেই আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু এবার অর্থবছরের তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও সরকারের ৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের ১ শতাংশ টাকাও খরচ করতে না পারাটা হতাশাব্যঞ্জক। এসব বিভাগ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের এ বিষয়ে একটা জবাবদিহি থাকা দরকার। এই জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গোটা এডিপির কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যেই পদ্ধতিগতভাবে অনুপস্থিত। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) অনেকটা যান্ত্রিকভাবে এডিপির অগ্রগতি তদারক করে। কে কোন কারণে পিছিয়ে পড়ল এবং তার সঙ্গে দুর্নীতির কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা হয় না। গত জুলাইয়ে আমরা জেনেছি যে সব মিলিয়ে সাতটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা সারা বছরে এডিপি বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও খরচ করতে পারেনি। এমনকি আইএমইডি এবং দুদকের মতো সংস্থা, যারা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দায়িত্বে, তারা তাদের নির্দিষ্ট প্রকল্প যথাসময়েও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সেদিক থেকে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে আলোচ্য ছয়টি বিভাগের (আইন ও বিচার, সংসদ সচিবালয়, জননিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি কর্ম কমিশন) দৈন্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেখিয়েছে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়। অথচ তাদেরই সবচেয়ে ভালো কাজ দেখানোর কথা। কারণ, প্রয়োজনের তুলনায় তাদের বাজেট বরাদ্দ কম। বাজেট এতটাই কম যে বিরোধী দল গত সংসদ অধিবেশনে বরাদ্দ নিয়ে এক ব্যতিক্রমী ‘রসিকতা’ করেছিল। তারা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ছাঁটাই করে মাত্র এক টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছিল। প্রায় ৩০ লাখ মামলার জট বিচার বিভাগের কাঁধে। সুতরাং সবচেয়ে ব্যবস্থাপনাগত উৎকর্ষ তাদের তরফে দেখানোই প্রত্যাশিত। আইন ও বিচার বিভাগের অধীনে ছয়টি প্রকল্পে বরাদ্দ ৩৫০ কোটি টাকা। অথচ তিন মাসে (গত জুলাই-সেপ্টেম্বর) তারা দুই কোটি টাকাও খরচ করতে পারেনি। এ অবস্থা যদি এই বিভাগের দক্ষতার পরিমাপক হয়, তাহলে এটা অনুমেয় যে তাদের অতিরিক্ত বরাদ্দের দাবি আগামী অর্থবছরেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
সংসদ সচিবালয় আইন দ্বারা গঠিত একটি স্বাধীন সচিবালয়। ‘স্ট্রেনদেনিং পার্লামেন্টস ক্যাপাসিটি ইনটু পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইস্যুজ’ নামের একটি মাত্র প্রকল্প তাদের। ৮৩ লাখ টাকা বরাদ্দ। কিন্তু তিন মাসেও খরচের খাতাই খুলতে পারল না তারা। অথচ সিদ্ধান্ত নিতে তারা বাইরের কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থার মুখাপেক্ষী নয়।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতির দোহাই দেওয়া যাবে কিন্তু তা হবে সত্যের অপলাপ। কারণ, বছরের পর বছর এই চিত্র মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকছে। তুলনামূলক বিচারে উল্লিখিত অর্ধডজন বিভাগ ও সাংবিধানিক সংস্থা, যারা প্রথম প্রান্তিকে ১ শতাংশের নিচে থাকল, তারাই হয়তো শেষ প্রান্তিকে সিংহভাগ খরচের রেকর্ড গড়বে। তবে এই ছয়টির মতো যারাই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারবে না, তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা নিতে হবে। চলতি অর্থবছরের এডিপি সোয়া দুই লাখ কোটি টাকার। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে গড়ে ৮ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে। এটাও সন্তোষজনক নয়। প্রশ্ন হলো শেষ প্রান্তিকে কী ঘটে? তথাকথিত জুন-জুলাই সিনড্রোমে দেখা যায়, এডিপির অর্থ খরচের হিড়িক পড়ে। ঠিকাদারদের হাসি দেখে কে? বিল জমা পড়তে বাকি, পরিশোধে বিলম্ব ঘটে না। এটা বোধগম্য যে তখন প্রকল্পগুলোর গুণগত মান পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হয় না।
আমরা এডিপি বাস্তবায়নের চলমান রুগ্ণ ধারার অবসান আশা করি। যথাসময়ে কেন টাকা খরচ করতে পারে না, তার মূল্যায়ন জরুরি। আইএমইডি কিন্তু এ কাজের কাজটিই করে না।