প্রতিটি মৃত্যুই শোকের ও বেদনার। কিন্তু গত সোমবার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় একটি রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের ১২ আরোহীর মৃত্যুর ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসটি রেললাইনের ক্রসিং পেরোনোর সময় দ্রুতগামী ট্রেনটির সামনে পড়ে যায়। এরপর ট্রেনটি মাইক্রোবাসকে আধা কিলোমিটার দূরে ঠেলে নিয়ে যায়।
এই মৃত্যুর দায় কে নেবে? রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ না সড়ক ও জনপথ বিভাগ? মাইক্রোবাসচালকের বোঝার ভুল বা অপরিণামদর্শিতা এখানে কাজ করে
থাকতে পারে কিন্তু রেলক্রসিংটি ছিল উন্মুক্ত। অর্থাৎ সেখানে কোনো প্রতিবন্ধক ছিল না। কেবল সিরাজগঞ্জ নয়, সারা দেশেই রেললাইনে এ রকম অনেক উন্মুক্ত ক্রসিং আছে, যাকে মৃত্যুফাঁদ বললেও অতিশয়োক্তি হবে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে ২ হাজার ৫৪১টি রেলক্রসিং আছে, যার মধ্যে ২ হাজার ১৭০টি রেলক্রসিংয়ে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেই। যেসব রেলক্রসিংয়ে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা আছে, সেখানেও
অনেক সময় সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। আর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না থাকলে কী রকম ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। অধিকাংশ রেলক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক না থাকার কারণ হলো রেললাইন স্থাপিত হওয়ার পর যত্রতত্র সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো সম্পূর্ণ অরক্ষিত ও অনিরাপদ।
রেলওয়ের উন্নয়নে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে কিন্তু রেলক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক বসানোর মতো স্বল্প ব্যয়ের ও জনস্বার্থমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এই আচরণ অমার্জনীয়। তবে এটাই একমাত্র সমস্যা নয়। পুরোনো সেতু, ত্রুটিপূর্ণ লাইন, ক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক থাকলেও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে ও মানুষ মারা যাচ্ছে। মাসখানেক আগে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় রেলসেতুতে বগি লাইনচ্যুত হয়ে ৪ জনের মৃত্যু হয়। ফলে এককালীন নিরাপদ এই বাহন হয়ে পড়েছে ভঙ্গুর ও অনিরাপদ। এভাবে কোনো দেশের রেলওয়ে চলতে পারে না।
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি একের পর এক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলেও কর্তৃপক্ষ উদাসীন। তারা প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে দুর্ঘটনার দায় অন্যের ওপর চাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কুলাউড়ার ঘটনায় তারা অতিরিক্ত যাত্রী থাকাকে দায়ী করেছে। ট্রেনে কত যাত্রী উঠবে না উঠবে সেটি দেখার দায়িত্ব কার? এভাবে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপালে কোনো লাভ হবে না। উল্লাপাড়ার দুর্ঘটনার তদন্তে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করেছে এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। আশা করি, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন যথাসময়ে প্রকাশিত এবং দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে এর পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। রেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে রেলওয়ে এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে দুর্ঘটনার মাত্রা কমবে না।