৭৩–এর আইন সংশোধন জরুরি

উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা গোড়াতেই প্রশ্নবিদ্ধ হলো। এটা বরাবরের মতোই স্পষ্ট যে, নীল দলের ভোটাভুটি এবং সিনেটে তিন সদস্যের প্যানেল চূড়ান্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে সিদ্ধান্তটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের রাজনৈতিক মহল থেকেই নির্ধারিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার ক্ষমতাসীন দলপন্থী নীল দল সমর্থিত প্যানেলের নির্বাচিত অংশটি উপাচার্য নিয়োগ প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে পারেনি। আর বিরোধী বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সাদা দল এই প্রক্রিয়া এমনিতেই বর্জন করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা গেল নীল দলের শিক্ষকেরা বিতর্কমুক্তভাবে তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল দিতে পারলেন না। 

রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনব্যবস্থা যখন আস্থা হারাচ্ছে, তখন রাজনীতির বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যেসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনীব্যবস্থা চলমান রয়েছে, সচেতন মহলের উচিত তার পবিত্রতা রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখা। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সব স্তরে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়লে এবং অনিয়ম বাসা বাঁধতে শুরু করলে তার পরিণাম শুভ হওয়ার নয়।

এখন দুটো বিকল্প। আপাতত নির্বাচনী ফল মেনে প্যানেল চূড়ান্ত করা। আর ভবিষ্যতের জন্য ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করে এমন ব্যবস্থা করা, যাতে রাজনীতির প্রভাব এড়িয়ে ও বিতর্ক ছাড়া উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল উপযুক্ত নীতিমালা নির্ধারণ করে বাছাই কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে থাকে। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের আওতায় যে যথাযথভাবে উপাচার্য নিয়োগ নিশ্চিত করা যাবে না, তা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। 

 বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেখানে বিরোধী শিক্ষকেরা ‘কলঙ্কিত ডাকসু’ নির্বাচনসহ তিন কারণে বিদ্যমান সিনেটকে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করে বর্জন করেছেন, সেখানেও আমরা দেখি নীল দল বিনা বিতর্কে ‘খালি মাঠে গোল’ দেওয়ার পর্যায়েও নেই। বিএনপির স্থানীয় নির্বাচন বয়কটে ধারণা করা হয়েছিল যে, ক্ষমতাসীন দল নির্ভেজাল স্বস্তি পাবে। কিন্তু দেখা গেছে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ আরও বেশি জটিলতায় ডালপালা বিস্তার করেছে। 

এটা সন্দেহ করার কারণ আছে যে নির্বাচনের ফলাফলের ধারাক্রম বজায় না রাখার উদ্দেশ্য হলো আচার্যের সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বিতর্কমুক্ত রাখা। প্যানেলভুক্ত তিন শিক্ষকের মধ্যে অন্যরূপ বিশেষ কারণ না থাকলে আচার্য সাধারণত এক নম্বরে থাকা শিক্ষককেই উপাচার্য নিয়োগ দেবেন। তাই নীল দলের নির্বাচনী ফলাফলে ‘ঘষামাজা’র মতো একটি উদ্দেশ্যমূলক ঘটনা ঘটেছে। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মান–মর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বর্তমান উপাচার্য পেয়েছেন ৩৬ ভোট। অথচ সহ-উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সামাদ পেয়েছেন ৪২ ভোট। তৃতীয় অবস্থানে এসেছেন অধ্যাপক মাকসুদ কামাল। এখন আচার্য যে প্যানেলটি বিবেচনা করবেন, সেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবেন সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্তধারী। নীল দলের সহ-আহ্বায়ক অধ্যাপক সামাদ তাই ‘নির্বাচন জালিয়াতির’ যে অভিযোগ করেছেন, তা নাকচ করা যাবে না। 

আমরা স্মরণ করতে পারি যে, ২০১৭ সালে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতি ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। উপাচার্য প্যানেল বিরোধ আদালতেও গড়িয়েছিল। ১৯৯৩ সালের পর এবারই প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিনেটে উপাচার্য প্যানেল মনোনীত হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ কী হলো? তালিকায় ফলাফলের ধারাক্রম বজায় না রাখার ঘটনা প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে 

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন, সম্মানের। এর নির্বাচনের ক্ষেত্রে আস্থা, পরিচ্ছন্নতা থাকা দরকার। এই পদটির একটি অসাধারণ প্রতীকী মূল্য আছে। এর সুরক্ষা কাম্য। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন বজায় রেখে তা নিশ্চিত করা যাবে না।