অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত

উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিম্ন কর্মসংস্থান

কয়েক বছর ধরে আমাদের অর্থনীতির আকার যে হারে বেড়ে চলেছে, তাকে অনেক বিশেষজ্ঞই বিস্ময়কর সাফল্য হিসেবে অভিহিত করেছেন। পৃথিবীর মুষ্টিমেয় উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা দেশের তালিকায়ও বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকের মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। 

এই উৎসাহব্যঞ্জক তথ্যের পাশাপাশি যে খবরটি আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে, তা হলো প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে না। দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এক জায়গায় থমকে আছে। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা তো আছে। তবে তাঁরা খোলাসা করে যে কথাটি বলছেন না, তা হলো যেকোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান করতে হলে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় এবং ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিতে হয়। এ অবস্থায় কেউ বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন না। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার; ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যা ছিল ২৬ লাখ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেকারত্বের হার ছিল ২০১০ সালে, ২০ লাখ। ২০১২ সাল ও ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ লাখ ও ২৮ লাখে। সংস্থাটির পূর্বাভাস ছিল ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ৩০ লাখে উঠবে। বাস্তবে বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। যাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টাও মজুরির বিনিময়ে কোনো কাজ পান না, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও তঁাদের বেকার হিসেবে চিহ্নিত করে। 

উল্লেখ্য, প্রতিবছর আমাদের শ্রমবাজারে যে ২১-২২ লাখ তরুণ-তরুণী যুক্ত হয়, যাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি কাজ পায় না। আবার যারা কাজ পায়, তাদেরও একটা বড় অংশ অর্ধবেকার বা ছদ্মবেকারের জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। কেননা, তারা নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী কাজ পায় না। গত ১০ বছরে কৃষি খাত, নির্মাণ ও অবকাঠামো খাতে কর্মসংস্থান কমেছে। সরকার মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতুর মতো যেসব বৃহৎ প্রকল্পের কাজ করছে, তাতেও খুব বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। বর্তমানে সেবা ও শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বাড়লেও তা আশানুরূপ নয়। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ। অথচ গত ১০ বছরে কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ১০ লাখ। বেকারত্ব শুধু অর্থনৈতিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে না; সামাজিক ক্ষেত্রেও অনেক গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করে। দেশে হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, মানব পাচারসহ গুরুতর অপরাধ বাড়ার পেছনেও বেকারত্ব ভূমিকা পালন করে। 

আরও উদ্বেগের বিষয়, বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বেকারত্বের হার বেশি। আবার শ্রমবাজারে যে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তির চাহিদা আছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তার জোগান দিতে পারছে না। এ কারণে অনেক শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে দক্ষ শ্রমশক্তি আমদানি করে থাকে। এই বাস্তবতা আমাদের উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা ও শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের দাবি রাখে। যে উন্নয়ন পরিকল্পনা বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করে না, সেই উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। যুগের চাহিদা পূরণ তথা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করতে সক্ষম একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

 যে বাংলাদেশ মিসকিনের দুর্নাম মুছে ফেলতে পেরেছে, সেই বাংলাদেশ বেকারির বদনামও আশা করি ঘোচাতে পারবে। বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বেকারির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতেই হবে।