দায় অস্বীকার করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না

ই-কমার্সে প্রতারণা

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

‘ই-কমার্সে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের দায়ভার সরকার নেবে না’ বলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা দায়িত্বপূর্ণ বক্তব্য নয়। এ ধরনের বক্তব্যে ই-কমার্সের নামে প্রতারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা স্বস্তিবোধ করলেও লাখ লাখ গ্রাহকের অর্থ ফেরত পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে। গত শুক্রবার রংপুরে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড নামের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনকালে তিনি এ বক্তব্য দিয়েছেন।

মন্ত্রীর যুক্তি হলো, গ্রাহকেরা কম মূল্যে পণ্য কিনতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং তাঁরা কমে পণ্য কেনার বিষয়টি সরকারকে জানাননি। একই সঙ্গে যেসব ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান অনিয়ম–দুর্নীতি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকার কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের কোনো দায়িত্ব না নেওয়ার ঘোষণা, অন্যদিকে যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণার মধ্যে দায়িত্বশীলতার অভাব রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া সরকারের পক্ষে কতটা সম্ভব, তা নিশ্চয়ই এক বড় প্রশ্ন। কিন্তু যে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো দিনের পর দিন জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারল, তার দায় সরকার অস্বীকার করবে কীভাবে? সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কারণেই জনগণ প্রতারিত হয়েছে।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের সঙ্গে গোপনে লেনদেন করেছে, এমন নয়। তারা প্রকাশ্যে, পত্রিকায়, টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিয়ে পণ্য বিক্রি করেছে। তাদের পণ্যের পক্ষে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক জগতের তারকা প্রচার চালিয়েছেন। এসব কারণে সাধারণ গ্রাহকেরা যদি প্রলুব্ধ হয়েও থাকেন, এককভাবে তাঁদের দায়ী করা যায় না। গ্রাহকের ক্ষতিপূরণ প্রতারক প্রতিষ্ঠান দেবে, না সরকার দেবে—সেই সিদ্ধান্তও মন্ত্রী দিতে পারেন না। আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। সরকারের দায়িত্ব হলো যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এসেছে, সরকারের দায়িত্ব তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। এসব প্রতিষ্ঠানের যে সম্পদ আছে, তা জব্দ করে হলেও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায় সরকারের রয়েছে। বিষয়টি যেহেতু আদালতে বিচারাধীন, তাই মন্ত্রী বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এমন কিছু বলা উচিত নয়, যা প্রতারকদের উৎসাহিত করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

আগেও অনেক মানুষ যুবক, ডেসটিনির মতো বহু ধাপবিশিষ্ট বিপণন প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার শিকার হয়েছিল। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা জেলে থাকলেও গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, তাদের যে সম্পদ আছে, তা বিক্রি করে গ্রাহকদের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ অর্থ ফেরত দেওয়া যায়।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যখন বলেন এখানে সরকারের দায় নেই। এতে কি বেআইনি ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড করে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেকটা দায়মুক্তি দেওয়া হয় না? ই–কমার্সের প্রতারণার বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে ভবিষ্যতে কীভাবে এ ধরনের প্রতারণা ঠেকানো যায়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণ ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। ই–কমার্সের কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকেরা বছরের পর বছর প্রতারিত হতে থাকবে, আর সরকারের মন্ত্রীরা দায় অস্বীকার করতে থাকবেন, তা কোনোভাবে কাম্য নয়।