ইসিকে জবাবদিহি করতেই হবে

বুধ ও মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত ছবি দুটিই বলে দেয় সাত ধাপে শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন কেমন হয়েছে। বুধবারের ছবিতে দেখা যায়, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষকে হামলাকারী ছয় ব্যক্তির চারজনই নৌকা প্রার্থীর সমর্থক। বাকি দুজন বিদ্রোহী প্রার্থীর। আর মঙ্গলবারের ছবিতে আছে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার একটি কেন্দ্রের পাশের কৃষিজমি রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

কেবল সাতকানিয়া নয়, দেশের প্রায় সব জেলা-উপজেলায় নির্বাচন নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, ভোটকেন্দ্র দখল, ভাঙচুরের ঘটনাও কম হয়নি। ভোটকেন্দ্রিক সংঘাতে ১০১ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ঘটেছে দ্বিতীয় ধাপে ৩০ জন। নির্বাচন তো মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার জন্য। সেখানে কেন এত হানাহানি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটল?

মানুষ সাধারণত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়। কিন্তু কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন সেই শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি বলেই ইউপি নির্বাচনে এত অঘটন ঘটল। অতীতে আমরা দেখেছি, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটত। এক দল অপর দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করত। কিন্তু এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মারামারি-হানাহানি হয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও মনোনয়নবঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করেছে, যদিও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তাদের দলের কেউ কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। অন্যান্য দলের প্রার্থীরা ভয়ে নির্বাচনী প্রচারই করতে পারেননি। মাঠের দখল নিয়ে লড়াইটা হয় নৌকা ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ যুক্তিতে সাত দফায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করেছে, যাতে পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ থাকে। কিন্তু বাস্তবে তার বিপরীত ঘটনাই ঘটেছে। প্রথম দফার চেয়ে দ্বিতীয় দফায় বেশি সংঘাত হয়েছে, দ্বিতীয় দফার চেয়ে তৃতীয় দফায়। নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব যাদের, সেই নির্বাচন কমিশন আগাগোড়া নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, সংঘাতের দায় তাঁদের নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দলের।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দলের ওপর দায় চাপিয়ে সিইসি কিংবা নির্বাচন কমিশন নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কমিশনের অধীনে থেকেই কাজ করে। নির্বাচনের সময়ের সংঘাতের দায় যদি কমিশন না নেয়, তাহলে তাদের দরকার কী? নির্বাচনের আগ্রহী ব্যক্তিরা সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হবেন এবং যাঁর যত বেশি পেশিশক্তি, তিনি চর দখলের মতো ভোটকেন্দ্র দখল করবেন, যা ইউপি নির্বাচনে ঘটেছে। নির্বাচনী অরাজকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থক নয়, সন্ত্রাসীদের কিরিচের কোপে ১৩ বছরের শিশুকেও জীবন দিতে হয়েছে।

কোনো সভ্য দেশে নির্বাচনের নামে এ সহিংসতা চলতে পারে না। পাঁচ বছর ধরে এ কমিশন নির্বাচনের নামে যেসব অঘটন ঘটিয়েছে, তার জন্য তাদের জবাবদিহি করতেই হবে। তারা নির্বাচনী ব্যবস্থার যে সর্বনাশ করেছে, ভবিষ্যতে যাঁরাই আসুন না কেন, তা পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বলে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কোনোভাবে দায়মুক্তি পেতে পারে না।