বাংলাদেশের কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পান না। আবার কৃষিপণ্যের ভোক্তারা সারা বছরই কোনো না–কোনো পণ্যের চড়া দামে হিমশিম খান। সাধারণত পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, বেগুন ও অন্যান্য শাকসবজির ‘বাজারে আগুন’ লেগেছে বলে সংবাদ শিরোনাম ছাপা হয়। ‘পেঁয়াজের ঝাঁজ’ সংবাদমাধ্যমে বহুল ব্যবহৃত শব্দবন্ধ। গত বছর পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। এ বছরও পেঁয়াজ ইতিমধ্যে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে, কারণ দাম বেড়েছে।
এবার পেঁয়াজের পাশাপাশি যে আরেকটি কৃষিপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে, তা হচ্ছে আলু। সরকারি সংস্থা টিসিবি বলছে, আলুর বাজারদর বেড়ে কেজিপ্রতি ৪০-৫০ টাকায় উঠেছে। গত বছর এই সময়ে দাম ছিল ২০- ২৫ টাকা। অর্থাৎ আলুর দাম সরকারি হিসাবেই বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। কিন্তু প্রথম আলোসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের খবর হলো, আসলে এখন আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে। এটা খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। কারণ, আলুর দাম কোনো বছরই এই সময় প্রতি কেজি ৩০ টাকার বেশি হয় না।
আলুর এই দাম বৃদ্ধি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাও বটে। কারণ, বাংলাদেশে আলুকে বলা যেতে পারে দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে চালের পরেই আলুর স্থান। বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য, যাঁরা প্রয়োজনীয় পরিমাণ শাকসবজি কিনতে পারেন না, সবজি হিসেবে আলুর ওপরেই তাঁরা সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। সেই আলু যদি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়, তাহলে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের পরিবারে বেশ আর্থিক চাপ সৃষ্টি হওয়ার কথা। বিশেষত এই সময়ে, যখন সব ধরনের শাকসবজির বাজার বেশ চড়া।
প্রশ্ন হলো, এ বছর এই সময়ে আলুর দাম এমন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে। প্রথমত, কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর লকডাউন, দীর্ঘ সাধারণ ছুটি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা, বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকা হারানো ইত্যাদি কারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যসাহায্যের প্রয়োজন হয়। বেসরকারি উদ্যোগে যেসব ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে, তার খাদ্যতালিকার অন্যতম উপাদান ছিল আলু। এভাবে প্রচুর পরিমাণ আলু বিতরণ হয়েছে। তা ছাড়া চলতি অর্থবছরে আলুর রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে রপ্তানি হয়েছিল ৩ লাখ ৩৬ হাজার ডলার মূল্যের আলু। আর চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ৪৮ হাজার ডলার মূল্যের আলু। অর্থাৎ, এ বছর বিপুল পরিমাণ আলু দেশের বাইরে চলে গেছে। আলু রপ্তানি এভাবে বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হলো সরকারের ২০ শতাংশ ভর্তুকি। এর কারণে আলু রপ্তানিকারকেরা রপ্তানি বাড়াতে উৎসাহ পেয়েছেন।
বাজারে যখন সব ধরনের শাকসবজির দাম বেশ চড়া, তখন আলুর দাম যদি আরও বেড়ে যায়, তাহলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে আর্থিক চাপ আরও বাড়বে। এমনকি তাঁদের পুষ্টিগত সমস্যাও সৃষ্টি হবে। এ পরিস্থিতিতে আলুর বাজার স্থিতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর গত সপ্তাহে আলুর দাম বেঁধে দিয়েছে। হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি ২৩ টাকা, পাইকারি ২৫ ও খুচরায় ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে তা মানা হচ্ছে না। সরকারের নির্ধারিত দাম কার্যকর করতে নিয়মিত নজরদারি দরকার। পাশাপাশি টিসিবি আলু কিনে কম দামে বিক্রির উদ্যোগ নিতে পারে। অভ্যন্তরীণ বাজারে আলুর চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে সাময়িকভাবে রপ্তানি বন্ধ করা অথবা রপ্তানির ক্ষেত্রে ভর্তুকি তুলে নেওয়া যেতে পারে।
যেভাবেই হোক, আলুর দাম আর বাড়তে দেওয়া চলবে না।