বুয়েট পরিস্থিতি সমগ্র জাতির ক্যাম্পাসজীবনের জন্য একটি সতর্ক বার্তা হিসেবে দেখার সুযোগ তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো শুধু জ্ঞানচর্চার আধারই হবে না; প্রতিটি ক্যাম্পাস হবে শৃঙ্খলা, বিনয়, সৌজন্য, শিষ্টাচারসহ মুক্তবুদ্ধির উৎকৃষ্ট পীঠস্থান। অথচ প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি আজ তথাকথিত গণরুম কালচার, র্যাগিং ইত্যাদিতে ক্ষতবিক্ষত। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ইতিমধ্যেই তা মরণব্যাধি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনগুলো শিক্ষাজীবন–বিধ্বংসী এসব ক্ষত নিরাময়ে উদাসীন। তারা বরং যথাসাধ্য এই কালিমা, এই কালিঝুলি কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখতেই অতিমাত্রায় ব্যগ্র। আজ সময় এসেছে এই নীরবতা ভেঙে দিয়ে শুদ্ধীকরণের লক্ষে্য জেগে ওঠা এবং বুয়েটে সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সেটা শুরু হলো। এটা শুধু বুয়েটেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, কিংবা সংগঠনভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হবে কি হবে না, সেই বিতর্কে সামনে এসেছে। সব থেকে জরুরি হলো সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ পুরো প্রশাসনকে রাজনীতি বাদ দিয়ে পেশাদারত্বের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান চালাতে হবে; শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলোর শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও পড়াশোনার পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উপাচার্য, প্রক্টর, প্রভোস্টসহ সবার ব্যর্থতার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আজ এমন দুর্দশা হয়েছে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের লেজুড় ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যাবতীয় নির্যাতন–যজ্ঞের কুশীলব হয়ে উঠতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনে দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ব্যর্থতার কারণেই।
র্যাগিংসহ নানা ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার নিয়মিত চর্চা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলে আসছে। সাধারণভাবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে র্যাগিং (শারীরিক নির্যাতন) বা বুলিং (উত্ত্যক্তকরণ) বিশ্বব্যাপী ক্যাম্পাসগুলোর জন্য একটি সমস্যা। ইদানীং যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে ট্রল (ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ) করা। এসব রুখতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের উদ্যাগী হওয়ার বিকল্প নেই। বুয়েট ঐতিহ্যগতভাবে দলাদলি ও দলীয়করণের দূষণমুক্ত ছিল। এমনকি দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য বা শিক্ষক নিয়োগের ঘটনাও সেখানে অপেক্ষাকৃত কম। তদপুরি সেখানে আমরা হঠাৎ করেই জানলাম, আবরার একাই নির্যাতনের শিকার হননি। একই ধরনের নির্যাতনের দুই শতাধিক নথিভুক্ত অভিযোগ ছিল, কিন্তু সেসবের প্রতি কখনো নজর দেওয়া হয়নি। আবরার নিহত না হলে হয়তো এত বিশদভাবে জানা যেত না যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই নির্যাতন–চর্চা এত ব্যাপক ও বিপজ্জনক রূপ ধারণ করেছে।
শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং নীরবে হতো। কেউ অভিযোগ দিত না। কিন্তু গত বছর ২১ জনের বিরুদ্ধে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। র্যাগিংয়ে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রলীগের দুজন আজীবনের জন্য তাৎক্ষণিক বহিষ্কৃত হন। এটি প্রশাসনিক সাফল্যের উদাহরণ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও আংশিক সাফল্য আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অন্তত ১০টি উপপক্ষের মধ্যে বহু সংঘাত, এমনকি তাতে আটজন নিহতও হয়েছেন। ২০১৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর র্যাগিং বন্ধে ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে বসেছিলেন। এতে সুফল কিছুটা মিলেছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৩ মার্চ র্যাগিংয়ের দায়ে বহিষ্কৃত সাত শিক্ষার্থী দিব্যি ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রশাসন নির্লিপ্ত। ২০১৭ সালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ জনের ওপর রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত চালানো হয়েছিল শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। তারও প্রতিকার মেলেনি।
সুতরাং আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তরফে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা অপরিহার্য।