তাঁর কর্ম ও সাধনা হোক আমাদের প্রেরণা

আনিসুজ্জামানের প্রয়াণ

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুসংবাদ আমাদের সবার জন্য গভীর শোকাবহ ও বেদনাবিধুর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা, গবেষণা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণ এবং জাতির গণতান্ত্রিক মানস গঠনে তাঁর নিরন্তর সাধনা রবীন্দ্রনাথের কবিতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’ সর্বার্থেই তিনি ছিলেন মৃত্যুহীন প্রাণ। তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।

আনিসুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিশ্রমী গবেষক ছিলেন, তিনি বৃত হয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে, দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। দেশের বাইরেও তাঁর কাজের স্বীকৃতি মিলেছে। কিন্তু এসব সম্মান ও স্বীকৃতির অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন তিনি।

ছাত্রাবস্থায় আনিসুজ্জামান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। ষাটের দশকের বৈরী সময়ে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির রবীন্দ্রবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে আরও অনেকের সঙ্গে আনিসুজ্জামানের দৃঢ় অবস্থান নবোত্থিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শাণিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালে উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। সংস্কৃতি ও রাজনীতির মেলবন্ধনে তাঁর সেই সময়ের ভূমিকা ছিল অসামান্য।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আনিসুজ্জামান কেবল সক্রিয়ভাবে অংশ নেননি, শিক্ষক সমিতির অন্যতম নেতা হিসেবে এর পক্ষে জনমত গঠন করেছেন, মুজিবনগর সরকার গঠিত প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবেও অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর ড. কুদরাত–এ–খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে নবীন দেশের শিক্ষানীতি প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন এই শিক্ষাবিদ।

বাংলাদেশ সংবিধান রচনার সঙ্গে আনিসুজ্জামানের যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনসাধনার আরেকটি অধ্যায় উন্মোচিত হয়। তিনি চার মূলনীতি বিধৃত সংবিধানটির কেবল ভাষান্তর করেননি, মর্মেও তা লালন করেছেন। আনিসুজ্জামান বরাবর একটি গণতান্ত্রিক, উদার, সহিষ্ণু ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন এবং নিজের অবস্থান থেকে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সব সময়ই সচেষ্ট থেকেছেন। আশির দশকে স্বৈরাচারী এরশাদের প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম বিধানের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ৩১ বুদ্ধিজীবীর একজন হয়ে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা, বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধ দৃঢ় অবস্থান নেওয়া ছিল তাঁর গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক জীবনদর্শনের প্রতিফলন।

আনিসুজ্জামান যে গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন, শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ও বাইরে বহু মানুষকে তাতে যেভাবে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছেন, সেখানেই তাঁর সার্থকতা। উন্নত রুচি, সংযম ও পরমতসহিষ্ণুতা চর্চায় তিনি ছিলেন আদর্শ। ছিলেন অনুচ্চকণ্ঠ, কিন্তু নীতি ও আদর্শের ব্যাপারে আপসহীন। নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠা গণ–আদালতে তিনি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা উত্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে মৌলবাদীদের হুমকি অগ্রাহ্য করে তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

আনিসুজ্জামানের মৃত্যু জাতীয়ভাবে অপূরণীয় এক ক্ষতি। তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার মতো নয়।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি যে সহিষ্ণু ও গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই সমাজ নির্মাণ প্রক্রিয়াকে যদি আমরা এগিয়ে নিতে পারি, সেটাই হবে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন। তাঁর কর্ম ও সাধনা হোক আমাদের প্রেরণার উৎস।