দুর্ঘটনা যেকোনো স্থানে ঘটতে পারে; কিন্তু হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ), যেখানে সবচেয়ে গুরুতর রোগীদের জীবন রক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা চলে, সেখানে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু গত বুধবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউতে এক অগ্নিকাণ্ডে তিনজন রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। সুচিকিৎসা পাওয়া ও রোগমুক্ত হওয়ার আশায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে যে মানুষেরা এমন মর্মান্তিকভাবে জীবন হারালেন, তাঁদের জন্য আমাদের শোক ও সমবেদনা জানানোর ভাষা নেই।
আগুন কীভাবে লেগেছিল, তা জানার জন্য দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা আশা করি সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে আগুন লাগার কারণ এবং তার জন্য কারও কোনো দায় থাকলে তা চিহ্নিত করা হবে এবং যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেখানে চিকিৎসাধীন রোগীদের প্রত্যক্ষদর্শী আত্মীয়স্বজনের ভাষ্য থেকে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, একজন রোগীর অক্সিজেন পাইপ থেকে প্রথমে ধোঁয়া এবং তার পরপরই অগ্নিকাণ্ডের সূচনা ঘটে। তাঁদের কেউ কেউ এমন অভিযোগ করেছেন যে আগুন লাগার পর সেখানে কর্তব্যরত নার্স ও অন্য কর্মীরা রোগীদের সাহায্য করতে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আইসিইউ থেকে বেরিয়ে যান। এ অভিযোগ সত্য হলে তা অবশ্যই দায়িত্বজ্ঞানহীন ও দুঃখজনক। এটা হাসপাতালের কর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতির নামান্তরও বটে। হাসপাতালের কর্মীদের কাছে এমন অসংবেদনশীলতা ও দায়িত্বহীনতা প্রত্যাশিত নয়। আমরা আশা করব, তদন্তের সময় এ দিকগুলোর দিকে লক্ষ রাখা হবে।
যান্ত্রিক বা কারিগরি ত্রুটির কারণে আগুন লেগে থাকলে তা যারপরনাই উদ্বেগজনক। কারণ, হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে এ ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি রোগী, চিকিৎসক, নার্সসহ সবার জন্যই প্রাণঘাতী হতে পারে এবং সেটা একেবারেই অস্বাভাবিক। গুরুতর রোগীদের জীবন রক্ষার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ জরুরি হয়ে পড়ে। অক্সিজেন দাহ্য গ্যাস। কিন্তু সেই অক্সিজেন সরবরাহ করতে গিয়ে যদি আগুন লাগার ঝুঁকি থাকে, তাহলে প্রথমেই সে রকম ঝুঁকি সম্পূর্ণভাবে দূর করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
এর আগে গত ২৭ মে রাতে ইউনাইটেড হাসপাতাল নামে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের করোনাভাইরাস ইউনিটে আগুন লেগে পাঁচ রোগীর মৃত্যু ঘটে। কিন্তু সেখানে আগুন লেগেছিল হাসপাতালের মূল ভবনের বাইরে একটি অস্থায়ী তাঁবুতে তৈরি করা করোনাভাইরাস ইউনিটে, আইসিইউতে নয়। বস্তুত কোনো হাসপাতালের আইসিইউতে আগুন লেগে রোগীদের প্রাণহানির ঘটনা অত্যন্ত বিরল। এমন বিরল ঘটনা কীভাবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ঘটতে পারল, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়।
এ বিস্ময়ের সঙ্গে উদ্বেগও থেকে যাচ্ছে, তবে কি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রও দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়? বিশেষত অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে? আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে চাই। এমন অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি আর একটিবারও ঘটতে দেওয়া চলবে না। দেশের হাসপাতালগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সব ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে সরকারি-বেসরকারি সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি।