আইনের শাসনে অবনতি

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) শুক্রবার যে বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচক প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪তম। এর অর্থ আমরা পেছনের দিক থেকে সামনের সারিতে আছি। এ অবনতি কেবল আইনের শাসনে নয়, গণতন্ত্র, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকারের সূচকগুলোতেও যে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি, তা জানতে বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদনের প্রয়োজন পড়ে না; খোলা চোখেই অনেক কিছু দেখা যায়।

সাতটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আইনের শাসনের এ সূচক করা হয়। এর মধ্যে আছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতার প্রয়োগ, ফৌজদারি বিচার ও দেওয়ানি বিচার পাওয়া, জননিরাপত্তা ও সরকারি তথ্য প্রকাশের মাত্রা। এর কোনোটিতেই আমাদের অগ্রগতির কোনো লক্ষণ নেই, বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা আগের অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আইনের শাসনে শীর্ষ অবস্থানে আছে নেপাল (৭০তম)। এরপরই শ্রীলঙ্কা (৭৬) ও ভারত (৭৯)। খারাপ অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের পরে আছে পাকিস্তান (১৩০) ও আফগানিস্তান (১৩৪তম)। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সূচকে যেসব দেশ আছে, সেগুলোর মধ্যে ৭৪ দশমিক ২ শতাংশই করোনাকালে আইনের শাসনের অবনতি হয়েছে। এসব দেশে বিশ্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষের বসবাস।

এ তথ্য-উপাত্তে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এই ভেবে স্বস্তিবোধ করতে পারেন যে বাংলাদেশ একাই অবনতির সারিতে নেই। আরও অনেকে আছে। কিন্তু এর বিষময় ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকেই। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির ও পূজামণ্ডপে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনেও আছে আইনের শাসনের ঘাটতি। অপরাধীরা পার পেয়ে গেলে একই অপরাধ বারবার ঘটতে থাকে। অব্যাহত রাজনৈতিক সংকট সত্ত্বেও আইনের শাসনে নেপাল দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে অবস্থানে থাকার বিষয়টি দৃষ্টান্তমূলক। হিমালয়ের পাদদেশের এই ছোট দেশ থেকে আমাদের অনেক শিক্ষণীয় আছে।

আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আয়নায় নিজেদের মুখ দেখার চেয়ে অতীতে কে কত খারাপ করেছে, সেই কাসুন্দি ঘাঁটতে ব্যস্ত থাকেন। সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে দুই মেয়াদ শেষ করে তৃতীয় মেয়াদের মাঝামাঝি এসে পড়েছে। আইনের শাসনের তারা এক পা এগিয়ে যদি তিন পা পেছায় তবে, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। এ পেছনের দিকে হাঁটা বন্ধ হবে কবে?

একই দিনে কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ও ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে নামের দুটি সংগঠন বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। এ অগ্রগতি ও অবনমন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তিতে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ভূমিকা প্রধান, আর আইনের শাসনের অবনতিতে সরকারের ভূমিকা প্রধান। প্রথমটির অগ্রগতির পেছনে আছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মেহনতি মানুষের সক্রিয় ভূমিকা। অন্যদিকে আইনের শাসনের অবনতির পেছনে রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের গাফিলতি, অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আইনের শাসনের অবনতি কেবল উদ্বেগজনক নয়, পীড়াদায়কও। আইনের শাসন নিশ্চিত করা যাদের দায়িত্ব বিলম্ব হলেও তাদের বোধোদয় হোক। বন্ধ হোক ভূতের মতো পেছনে হাঁটাও।