‘ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া’ নামে একটি প্রবাদ চালু আছে। কিন্তু বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইটি) শিক্ষার নামে যে কার্যক্রম চালু আছে, সেখানে ঘোড়াও নেই, গাড়িও নেই। সম্প্রতি প্রথম আলোয় তিন কিস্তিতে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আইটি শিক্ষার যে স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থী আছে তো শিক্ষক নেই। শিক্ষক আছেন তো কম্পিউটার প্রোগ্রাম চালানোর অবকাঠামো সুবিধা নেই।
যেকোনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার আগে যে প্রস্তুতি ও চিন্তাভাবনা থাকা দরকার, আইটি শিক্ষার ক্ষেত্রে যে তা একেবারেই ছিল না, তা স্পষ্ট। আইটি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, প্রথমে সরকারের চিন্তাভাবনা ছিল ২০১৩ সালে যারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছিল, তারা একাদশ শ্রেণিকে উঠলে আইটি শিক্ষা চালু করা হবে। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচন (২০১৪) সামনে রেখে ওই বছরই একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই সুবিবেচনাপ্রসূত ছিল না। উচ্চমাধ্যমিকে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার সাত বছর পরও এ বিষয়ে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। ফলে বাংলা, ইসলামের ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ের শিক্ষকদের দিয়ে আইটি পড়ানো হচ্ছে, যঁাদের লেখাপড়ার সঙ্গে প্রযুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই।
দেশে বর্তমানে ৬৩৪টি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক পড়ানো হয়। এই স্তরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ হাজার ৫৭৪। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ২৬ লাখের মতো। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর প্রতি সরকারের এ ধরনের উপেক্ষা ও অবহেলা অগ্রহণযোগ্য। সরকার মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছে কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আইটি শিক্ষার প্রসারে টেকসই ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।
তবে যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতিই আইটি শিক্ষার একমাত্র সমস্যা নয়। আইটি শিক্ষার সমস্যাটির গভীরতা আরও ব্যাপক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরা সরকারি-বেসরকারি কলেজের ২০ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তাদের ব্যবহারিক খাতা সংগ্রহ করে দেখা গেছে, ভুল প্রোগ্রামকেও সঠিক হিসেবে শিক্ষকেরা স্বাক্ষর করেছেন। আবার শিক্ষার্থীর সঠিক কম্পিউটার প্রোগ্রামকে ‘ভুল’ বলে শূন্য দিয়েছেন কোনো কোনো আইসিটি শিক্ষক। পরিস্থিতি কতটা শোচনীয় তা বোঝার জন্য এ দৃষ্টান্ত যথেষ্ট। শিক্ষকেরা যদি ভুলকে শুদ্ধ এবং শুদ্ধকে ভুল হিসেবে বিবেচনা করেন এবং ভুল-শুদ্ধ ধরার যোগ্যতা যদি তাঁদের না থাকে, তবে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে?
আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আইটির বইগুলোর লেখকেরা সিএসই বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী, কিন্তু সেই বইগুলো মূল্যায়নের জন্য এনসিটিবি সাতজন কলেজশিক্ষকে নিয়ে যে প্যানেল করেছে, তাঁদের একজন ছাড়া কেউ এ বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করেননি। তথ্যপ্রযুক্তির প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। কিন্তু আমাদের আইসিটি বইগুলো প্রোগ্রামিং করার জন্য যেসব সফটওয়্যার অনুসরণ করেছে, তা এক যুগের পুরোনো বলেও অভিযোগ আছে।
এভাবে ধার করা শিক্ষক বা মূল্যায়নকারী দিয়ে আইটি শিক্ষা চলতে পারে না। আইটির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আবশ্যিক পাঠ্যক্রম করার আগে যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল তা যেহেতু করা হয়নি, তাই আইটি শিক্ষার বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা ও সামগ্রিকভাবে বিষয়টি নতুন করে মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিগত বছরগুলোর দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এ খাতের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজটি করতে হবে। আইটি শিক্ষায় অভিজ্ঞ শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনে পৃথক বেতনকাঠামো তৈরির বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। একই সঙ্গে পাঠ্যক্রমকে নির্ভুল, যুগোপযোগী এবং নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে।