নদী জবরদখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান সফল করতে হলে প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা—দুটিই লাগবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশে স্থানীয় জেলা প্রশাসনগুলো ৫০ হাজারের বেশি অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করেছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো মামলা-মোকদ্দমা এড়িয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নদীগুলোকে অবৈধ দখলদারমুক্ত করা। তালিকা করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও এখন পর্যন্ত তহবিল-সংকটের সুরাহা হয়নি।
নদী কমিশন মনে করে, দখলদারদের উচ্ছেদে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা লাগবে। গত অর্থবছরেই এই পরিমাণ টাকার বরাদ্দ আশা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো মাত্র ৭৫ লাখ টাকার সংস্থান হয়েছিল। দেশের বহু স্থানে জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েও গত অর্থবছরে উচ্ছেদ অভিযানে নামতে পারেনি শুধু অর্থের অভাবে। চলতি অর্থবছরে লক্ষণ যে খুব উজ্জ্বল, তা বলা যাবে না। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন ১ কোটি টাকা চেয়ে পেয়েছে ২০ লাখের কম টাকা। এটা দুর্ভাগ্যজনক।
এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এ বিষয়ে আমরা অবিলম্বে একটি ঘোষণা আশা করি। আমরা চাই এই কাজে ভূমি মন্ত্রণালয়ের হাতে তারা কবে টাকাটা তুলে দিচ্ছে তার ঘোষণা দিক। এ ছাড়া বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার কাছে থাকা ভারী যন্ত্রপাতি যাতে জেলা প্রশাসন চাইলেই উচ্ছেদ অভিযানে ব্যবহার করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে সফল উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় ও বোঝাপড়ার বিকল্প নেই। নদীখেকোদের মধ্যে চুনোপুঁটির সংখ্যা বেশি হলেও রুই-কাতলার সংখ্যা নেহাত কম নয়। বগুড়ায় করতোয়া, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী, গাইবান্ধায় তিস্তার মতো কিছু নদীর প্রভাবশালী দখলদারেরা নদী কমিশনের নজরে রয়েছেন। এসব জায়গা থেকে তঁারা কিছু জটিলতার আশঙ্কা করেন।
তবে আমরা মনে করি, বাংলাদেশের নদী–নালাকে পুরোপুরি অবৈধ দখলদারমুক্ত করার ধারণার সঙ্গে নদীর সীমানা নির্ধারণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। নদীতীরে স্থায়ী সীমানাখুঁটি বসানোর কথা গত কয়েক বছরে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে স্থায়ী সীমানাখুঁটি বসানোর যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তা-ও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। শতকরা ৫০ ভাগও স্থায়ী খুঁটি বসানো সম্ভব হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে নদী রক্ষা কমিশন প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলা পর্যায়ের বড় নদীগুলোতে স্থায়ী সীমানাখুঁটি স্থাপন প্রকল্প জমা দিয়েছে। বর্তমানে জেলাগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীতে সীমানাখুঁটি অনুপস্থিত। সারা দেশের জেলা প্রশাসন দ্বারা অবৈধ দখলদারদের তালিকা চূড়ান্ত করার সময় এ মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যে বাকি থাকল, সেটা কম উদ্বেগের বিষয় নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নদ-নদী দখলকারীদের একটি তালিকা যে হলো, সেটা নিঃসন্দেহে বড় অগ্রগতি। কিন্তু আমরা মনে করি, ব্যাপকভিত্তিক উচ্ছেদ অভিযানে নামার আগে সম্ভাব্য সব ধরনের ঝুঁকি বিবেচনায় নিতে হবে। শীতলক্ষ্যার এক ডজনের বেশি ডকইয়ার্ড এবং মেঘনার পারে গড়ে ওঠা স্পিনিং মিল বা ইটভাটার মতো ভারী স্থাপনা সরানোর কাজটি সহজ হবে না। অনেক ক্ষেত্রে আইনি বাধার মুখেও পড়তে হতে পারে। তবে রিট মোকদ্দমার কবলে পড়ে যাতে উচ্ছেদকারী কর্তৃপক্ষের প্রাণ ওষ্ঠাগত না হয়, সে বিষয়েও তাদের সতর্ক পদক্ষেপ দরকার। নদীকে দখলমুক্ত করার উদ্যোগে হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনা মানার একটি বিষয় রয়েছে। তাই নদী কমিশন আগাম অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের সঙ্গে সম্ভাব্য পরামর্শ করে নিতে পারে।
তবে নদী পুনরুদ্ধারকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়া সম্ভব হলে প্রশাসনের পক্ষে কাজ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয়
রাজনৈতিক নেতৃত্বের, বিশেষ করে সরকারি দলের নেতাদের সহায়তা ও সমর্থনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।