বেসরকারি স্কুল-কলেজ–মাদ্রাসার যেসব অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর ভাতা ও কল্যাণ সুবিধার টাকা না পেয়ে বছরের পর বছর নিদারুণ সংকটে দিন কাটাচ্ছেন, তাঁদের ব্যথা সরকার আদৌ উপলব্ধি করতে পারে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কেননা, তাঁদের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারলে বাস্তবোচিত ও কার্যকর উদ্যোগ নিশ্চয়ই এত দিনে গৃহীত হতো। যে মানুষগুলো সারা জীবন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সেবা দিয়ে গেছেন, তাঁদেরই এখন জীবনের এই পর্যায়ে এসে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এটি জাতির জন্য লজ্জার।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, এসব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণ সুবিধার টাকা পেতে ত্রাহি অবস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে। অথচ এই খাত থেকে তাঁরা যে অর্থ পান, তার বড় অংশই তাঁদের বেতন থেকে জমা রাখা হয়। এখন নিজেদের সেই অর্থ পেতে কমপক্ষে আড়াই বছর পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দেড় বছরের আগে কল্যাণ সুবিধার টাকা পাওয়ার আশাই তাঁরা করতে পারছেন না। এই টাকা পাওয়ার জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট কার্যালয়ে তাঁদের নিত্যদিন ধরনা দিতে হচ্ছে।
অবসর ও কল্যাণ সুবিধা বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, এমপিওভুক্ত (বেতন বাবদ মাসে সরকারি অনুদান) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসরের পর দুই ধরনের সুবিধা পান। একটি অবসর সুবিধা, আরেকটি কল্যাণ সুবিধা। পরিমাণে অবসর সুবিধার টাকা বেশি। নিয়মানুযায়ী বয়স ৬০ বছর অথবা চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসরে যান। তবে কেউ মারা গেলে তাঁর পরিবার নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পায়। আবার অন্তত ১০ বছর পূর্ণ করে স্বেচ্ছায় অবসরে গেলে জমার টাকা সুদসহ পাওয়া যায়।
দেখা যাচ্ছে, সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধার টাকা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ১৯ হাজার ৭৩২ জন শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন জমা পড়ে আছে। আর কল্যাণ সুবিধার টাকা পেতে আবেদন জমা আছে ১৫ হাজার ১০০টি। আবেদনকারীরা টাকা পাচ্ছেন না। কারণ তহবিলের ঘাটতি।
আগে অবসর ও কল্যাণ সুবিধার জন্য মাসে মূল বেতনের যথাক্রমে ৪ ও ২ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হতো। পরে তা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৬ শতাংশ ও ৪ শতাংশ করা হয়। অবসর সুবিধার জন্য ৬ শতাংশ হারে টাকা কাটার পর বর্তমানে মাসে প্রায় ৬০ কোটি টাকা আদায় হয়। কিন্তু অবসর সুবিধা দিতে মাসে প্রয়োজন ৮০ কোটি টাকা। তার মানে বছরে ২৪০ কোটি টাকা ঘাটতি থাকছে। এখন আবেদনপত্র জমা দেওয়া সব শিক্ষক-কর্মচারীকে অবসর সুবিধার টাকা দিতে এককালীন আরও প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা দরকার।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, কল্যাণ সুবিধা খাতে বর্তমানে মাসে জমা হয় ৪০ কোটি টাকা। কিন্তু মাসে প্রয়োজন ৫০ কোটি টাকা। বছরে ঘাটতি ১২০ কোটি টাকা। আবেদন জমা থাকা ১৫ হাজার ১০০ জনকে কল্যাণ সুবিধা দিতে এককালীন ৮৫০ কোটি টাকা দরকার। বিভিন্ন অর্থবছরে এই খাতে সরকার ৩৬০ কোটি টাকা দিলেও তা যথেষ্ট নয়। সংকট নিরসনে প্রতিবছর অতিরিক্ত ১২০ কোটি টাকা প্রয়োজন।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে প্রায় সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকা। সেই দিক বিবেচনা করলে অবসরপ্রাপ্ত এসব বেসরকারি শিক্ষকের এই তহবিলের জোগান দেওয়া কঠিন হওয়ার কথা নয়। তাই সরকার আবেদনকারী সব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ভাতা দ্রুত মিটিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেবে, সেটাই প্রত্যাশিত।