ইংরেজি নববর্ষকে কি আর ‘সাহেবি উৎসব’ বলার জো আছে? মনে তো হয় না।
সাহেবেরা বিদায় নিলেও নানা কায়দার সাহেবিয়ানা বাঙালিয়ানায় অঙ্গীভূত হয়েছে। বাংলা ভাষার বৈঠকখানায় অনেক ইংরেজি শব্দ দূরসম্পর্কের নিকটাত্মীয়ের মতো বিরাট কুটুম্বিতার দাবি নিয়ে এমনভাবে গদি গেড়ে বসে গেছে যে তাদের সেই গদি ছেড়ে উঠে যেতে বলার অবস্থা আর নেই। তারা এখন বাঙালির ‘আপনার চেয়ে আপন যে জন’ হয়ে উঠেছে। এ কারণে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ কথাটিকে এখন আর বিলেতি ভাষাজ্ঞানে পর করে দিতে মনে সায় দেয় না।
‘একত্রিংশ রজনী’ কথাটার ইংরেজি কী? লেখাপড়া জানা অনেককে আমি নিজে এই প্রশ্ন করে দেখেছি। তাঁদের একটা বড় অংশই বলতে পারেনি। কিন্তু যেই বলেছি ‘থার্টি–ফার্স্ট নাইট’, ওমনি তারা ভিরমি খাওয়ার মতো চমকে গিয়ে থমকে থেকেছে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলেছে। তাঁদের কথা থেকে বুঝতে পেরেছি, ‘থার্টি–ফার্স্ট নাইট’ কথাটার যে একটি বাংলা অর্থ থাকতে পারে, সেটাই তাঁদের মাথায় ছিল না। শহর এলাকা দূরে থাক, প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের লোকও, বিশেষত তরুণ বয়সীদের বড় অংশ ‘থার্টি–ফার্স্ট নাইট’ কথাটার আক্ষরিক বাংলা মানে না জানলেও জিনিসটা যে কী, তা ভালোই বোঝে। তাঁরা সম্ভবত জানেন, ‘যে দিবাগত মধ্যরজনীতে বোমাসদৃশ কালিপটকার ব্রহ্মাণ্ডবিদারী নিনাদ ও অযুত আতশবাজির উল্লাসমুখর আলোকোজ্জ্বল আয়োজনে সদ্যাগত ইংরেজি বর্ষকে “হ্যাপি নিউ ইয়ার” ওঙ্কারধ্বনিসহযোগে স্বাগত জানানো হয়, উহাকে থার্টি–ফার্স্ট নাইট বলা হইয়া থাকে।’ ওই রাতে বহু আনন্দ আয়োজন হয়। অনেক জায়গায় ফানুস ওড়ানো হয়। রাজধানীর বাইরেও জমকালো আয়োজনে বাজি ফোটানো হয়। রাত ১২টা ১ মিনিট হলেই পরস্পরের মধ্যে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। ফেসবুকের পাতা কিংবা টুইটার হ্যান্ডেলে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’খচিত ডিজিটাল স্টিকার সেঁটে দেওয়া হয়। টাইপ করে ভুলভাল বানানে লেখার ঝক্কি বাদ দিয়ে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ সংলাপসর্বস্ব ভার্চ্যুয়াল কার্ড ফরোয়ার্ড করা তথা কার্ড চালাচালি হয়।
মেট্রোরেল চালু হয়েছে। পোশাক খাতে রেকর্ড আয় হয়েছে। নতুন সম্ভাবনা নতুন হাতছানি দিচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক মাঠ তেঁতে উঠে নতুন শঙ্কা জাগাচ্ছে। নতুন বছরে আশঙ্কা ও সম্ভাবনার সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে বলছি ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’।
তার মানে নতুন বছর হাসিখুশিতে কাটানোর একটা প্রত্যাশা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’–এর মধ্যে দৃশ্যত বেশ গাঢ়ভাবেই মেশানো থাকে। আসন্ন বছরটি খুশির সঙ্গে, শান্তির সঙ্গে কাটানোর একটা সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষার দ্যোতনা তাতে নিহিত থাকে। কিন্তু এবারের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা সেই আকাঙ্ক্ষাকে ফিকে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের দেহে টানা দুই বছরের জীবাণুঘটিত মহামারির ক্ষত এখনো দৃশ্যমান। এখনো চীনের কোনো কোনো শহরে সর্বাত্মক না হলেও আংশিক লকডাউন বিদ্যমান। দুনিয়াব্যাপী মহামারিজনিত মহামন্দা কাটানোর সুযোগ তৈরি হওয়ার আগেই রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। এই নিয়ে রাশিয়া ও তার মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ তাদের মিত্রদের অর্থনৈতিক মারামারি লেগে গেছে। এ–ওর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে; সে তার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করছে। আন্তর্জাতিক মোড়লদের এই মারামারির মাঝখানে পড়ে জ্বালানি ও তেলের বাজারে আগুন ধরে গেছে। খাদ্যপণ্যের সরবরাহশৃঙ্খল ছিঁড়ে গেছে। ডলারের দাম হু হু করে বেড়েছে। লোকে চাকরি হারিয়েছে। আমাদের বহু প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়ে ঘটিবাটি নিয়ে নিজ বাটীতে চলে এসেছেন।
এর জের ধরে দেশীয় পরিমণ্ডলে গন্ডগোল লেগে গেছে। করোনায় জেরবার পরিস্থিতির মধ্যে খাবি খাওয়া লোক শোকে–দুঃখে যখন দাঁতে কিড়িমিড়ি দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময় একধাক্কায় জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে এবং তার পর থেকে পাবলিকের দাঁত লেগে গেছে। এই অবস্থার মধ্যে ডলার সংকটে এলসি অংশত বন্ধ হওয়ার খবর বের হলো; এর মধ্যেই ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের একারই ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার খবর বের হলো। আরও আরও অর্থনৈতিক দুর্ঘটনার খবর আসছে। রাজনৈতিক আবহাওয়াও খুব সুবিধার মনে হচ্ছে না। বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে সরকারি ও বিরোধী পক্ষের যে চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তার রেশ এখনো কাটেনি। সব মিলিয়ে পাবলিকের কণ্ঠনালিতে একটা উৎকণ্ঠা দলা পাকিয়ে বসে আছে। সেই অবস্থায় তাদের পিয়ারের বন্ধু-ইয়ারদের ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলতে হচ্ছে।
তবে যেহেতু প্যানডোরার বাক্স থেকে দুঃখ, জরা, ব্যাধি—এসব বের হলেও ‘আশা’ বের হতে পারেনি, তাই আমরা নৈরাশ্যবাদী হতে পারি না। আমরা আশাবাদী। এর মধ্যেও অনেক আশাবহ ঘটনা ঘটছে। ঢাকার বুকে মেট্রোরেল চালু হয়েছে। গত পাঁচ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে রেকর্ড পরিমাণ (১ হাজার ৮৩৪ কোটি ডলার) আয় হয়েছে। এর আগে করোনা মহামারির থাবা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক অর্জন করে বাংলাদেশ। একটা নতুন সম্ভাবনা নতুন করে হাতছানি দিচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক মাঠ তেঁতে উঠে নতুন শঙ্কা জাগাচ্ছে। নতুন বছরে আশঙ্কা ও সম্ভাবনার সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে বলছি ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। ২০২৩ সাল আমাদের সামনে মহাকালের একটুকরো খেত। একটি সম্ভাবনার খেত। বর্ষ শুরুর এই শুভেচ্ছা সম্ভাষণের মধ্যেই আমরা ‘আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে/শরীরের অবসাদ হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে’।
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক sarfuddin2003@gmail. com