বছরজুড়ে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধই ছিল বড় খবর
বছরজুড়ে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধই ছিল বড় খবর

মতামত

ঠান্ডা যুদ্ধ যখন ঢাকায় এসে পৌঁছাল

২০২৩ সালের প্রথম সূর্য ওঠার সময় ইউক্রেন যুদ্ধের ৩১২তম দিন পেরোতে থাকবে। ২০২২ সালের প্রথম ভোরে এটি কেউ কল্পনা করেনি ইউরোপের বুকে একটা যুদ্ধ এত দিন চলতে পারে, আর জাতিসংঘসহ কথিত ‘আন্তর্জাতিক সমাজ’ সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর বিশ্ব জনসংখ্যা ৮০০ কোটির মাইলফলক পেরিয়েছিল।

মনে হচ্ছে, এখন থেকে এই ৮০০ কোটি মানুষকেই যুদ্ধবাজদের গোলার নির্বিঘ্ন খাবার হওয়ার শঙ্কা নিয়েই বাঁচতে হবে বিশ্বের সব প্রান্তে।

রয়টার্সের হিসাবে, গত ৩১১ দিনে ইউক্রেন যুদ্ধে ৪২ হাজার ৩০০ মানুষ মারা গেছে, নিখোঁজ আরও ১৫ হাজার। যুদ্ধই ছিল গত বছরের বড় খবর। ইউরোপবাসীকে নানা ধরনের জ্বালানি সংকটে নাস্তানাবুদ করেছে যুদ্ধ। ৭০ লাখ শরণার্থীও গ্রহণ করতে হয়েছে তাদের। বিশ্বের প্রতিটি রান্নাঘরকে এ যুদ্ধ বিপদে ফেলেছে। এ লড়াই বিশ্বের অন্যতম বড় সামরিক শক্তি রাশিয়াকে লজ্জায়ও ফেলেছে। ইউক্রেনের প্রচুর ক্ষতি করতে পারলেও দেশটিকে পদানত করতে সফল হয়নি তারা।

এই দুর্যোগের ভেতর ইউরোপ-আমেরিকা-চীনের সামরিক শিল্পে দারুণ প্রবৃদ্ধিও ঘটে যায়। যুদ্ধাস্ত্রের বৈশ্বিক বাজারের আকার আগের বছরে ছিল ৪৭৫ বিলিয়ন। ২০২২-এ হলো ৫১৪ বিলিয়ন। বৃদ্ধি প্রায় ৮ ভাগ। সরবরাহব্যবস্থায় নানা বাধা–বিপত্তির মধ্যেই তাদের এই প্রবৃদ্ধি চলছে।

আইএমএফের সামনে হাঁটু মোড়া ‘টাইগার’রা

ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের অর্থনৈতিক সফলতার মিথগুলোও উলঙ্গ হয়ে পড়ছিল। সে তালিকায় আছে দক্ষিণ এশিয়ার ২-৩টি দেশও। নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এত দিন এসব দেশকে ‘টাইগার’ হিসেবে দেখাচ্ছিল। অথচ এখন আইএমএফের কাছে তাদের হাঁটু মুড়ে প্রার্থনায় বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা ছাড়াও অন্তত আরও দুটি দেশ বিদেশি দেনার ফাঁদে আছে এ অঞ্চলে। এসব দেশের নীতিনির্ধারকেরা পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে যাচ্ছেন ক্রমাগত। কিন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে বাজার সিন্ডিকেটগুলো নতুন উদ্যমে সাধারণদের পকেট কাটতে পেরেছে। ঠিক এ কারণেই আংকটাডের হিসাবে এ বছর বিশ্ববাজার প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করলেও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির গতি বিপজ্জনকভাবে নিম্নমুখী।

অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের অগ্রযাত্রা থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাধা-নিষেধ কিছুটা কাজ করলেও পশ্চিমের অবরোধে রাশিয়া প্রত্যাশামতো বিপদে পড়েনি এ বছর। বরং ওয়াশিংটনের চাপ মস্কো-বেইজিংকে কাছাকাছি এনেছে। বহুকাল অর্থনৈতিক গোলকায়নের শোরগোল দেখেছে বিশ্ব। এখন শেষমেশ অর্থনৈতিক-জাতীয়তাবাদ মদদ পাচ্ছে বড় শক্তিদের কাছে। কিছু দেশ চেষ্টা করছে ডলারভিত্তিক লেনদেনের পরাধীন দুনিয়া থেকে মুক্ত হতে। কিন্তু প্রায় সব অর্থনীতিবিদের অনুমান, আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি খারাপ হবে।

দূতাবাসগুলোর নগরযুদ্ধ

একের পর এক অর্থনৈতিক দুঃসংবাদের পাশাপাশি অবিশ্বাস্য গতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের রণধ্বনিও বাড়ছিল এ বছর। তাইওয়ানকে ঘিরে ওয়াশিংটন ও বেইজিং নিয়মিত বাগ্​বিতণ্ডায় লিপ্ত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শাসকেরা অতীতের অস্পষ্টতা এড়িয়ে এ বছর খোলাখুলিভাবে তাইওয়ানের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। গণচীন তার উত্তর দিয়েছে নিয়মিত তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের জন্য যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে। তৃতীয় মেয়াদে দল ও সরকারপ্রধান হয়ে চীনের নেতা সি চিন পিংয়ের সামনে তাইওয়ানকে আয়ত্তে আনাই যেন প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের চীননীতিও আমূল বদলে গেছে। এ বছরে ভূরাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এটা। সেই সূত্রে আন্তর্জাতিক উত্তেজনার যাবতীয় উপাদান ক্রমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জড়ো হচ্ছে। তার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের গায়েও। শক্তিধর দেশগুলোর ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাসের প্রচার-প্রচারণাতেও ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তপ্ত আলামত দেখা যাচ্ছিল বছর শেষে। কূটনীতির এসব নগরযুদ্ধ আরও বাড়বে বলে অনুমান করা যায়।

সর্বশেষ বৈশ্বিক মেরুকরণে বড় এক চমক ছিল ওয়াশিংটনের পুরোনো মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের সখ্য। এতে ইরানও খানিক

হতবাক ও নিঃসঙ্গ হয়েছে। ইরান ছাড়া ওই অঞ্চলের অন্যান্য শক্তির মধ্যে ইসরায়েলকে কাছে টানার করুণ চেষ্টাও ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ২০২২ সালের গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা।

ইরানে দীর্ঘস্থায়ী গণ-আন্দোলন

ইরানে নারীদের গণ-আন্দোলন বিগত বছরের বড় আরেক বিস্ময় ছিল। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে এটা বছর শেষেও চলছিল। এই বিক্ষোভ নারীদের হিজাব পরা নিয়ে স্থানীয় নীতি-পুলিশের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে শুরু হলেও, ক্রমে সেটা গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে রক্ত দিতে শুরু করে। অদম্য বিক্ষোভে বিস্মিত ইরান সরকার একপর্যায়ে নীতি-পুলিশের কাজ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। তবে গণতন্ত্রপন্থীদের ধরপাকড় ও মৃত্যু অব্যাহত ছিল। প্রায় ৫০০ মানুষ এই আন্দোলনে মারা গেছে। তাদের মধ্যে আছে বহু নারী।

ইউক্রেন ও ইরানের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনাবলিও এ বছর বিশ্ব মনোযোগ পেয়েছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে নিয়মিত।

মধ্যপ্রাচ্যে খোলা হাওয়া

প্রথাবিরোধী এক গণ–আন্দোলনে শ্রীলঙ্কার মানুষ দেশকে রাজাপক্ষে বংশের পারিবারিক শাসনমুক্ত করে অন্যান্য দেশের কর্তৃত্ববাদীদের দুর্ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল গত বছর। কিন্তু আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে রাজাপক্ষেদের পরিবর্তে রনিল বিক্রমাসিংহেকে সপক্ষে টেনে দক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রকে নিজেদের কবজায় ধরে রাখতে পেরেছে। রাজাপক্ষেরা প্রাসাদ ছেড়ে যাওয়ার আগে অবশ্য দেশকে ৫১ বিলিয়ন ডলার ঋণের ফাঁদে ফেলে গেছেন।

বছর শেষে পাকিস্তানে এ রকম ঋণের বোঝা ছিল ১২৭ বিলিয়ন ডলার। আর গত ২ ডিসেম্বরে সেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার। দেশটি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জে আছে স্থানীয় তালেবান ‘টিটিপি’র দিক থেকেও। আফগান তালেবানের শর্তহীন সমর্থন ক্রমে ইসলামাবাদকে ভোগাতে শুরু করেছে। দুই দেশের দারুণ বন্ধুত্বের মধ্যে এক বছরের মধ্যে ডুরান্ট লাইনের দুই দিকে মাঝেমধ্যেই ইদানীং গোলাগুলি হচ্ছে।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের উদীয়মান এই টানাপোড়েনের পাশাপাশি এ অঞ্চলের বড় সংকট যাচ্ছে মিয়ানমারে। সামরিক জান্তার ক্ষমতার লোভ সেখানে সর্বগ্রাসী গৃহযুদ্ধ তৈরি করেছে। ২০২৩ দেশটিতে বাড়তি বিস্ফোরক অবস্থা তৈরি করবে বলেই খবর মিলছে।

এসবের মধ্যে নভেম্বর-ডিসেম্বরে সবাইকে উত্তেজক আনন্দ দিয়ে গেল সাত বিলিয়ন ডলারের কাতার বিশ্বকাপ। ফিফার র​্যাঙ্কিংয়ে ১৯২ নম্বরে থেকেও বিশ্বকাপের সংবাদে বাংলাদেশ হাজির ছিল দর্শক হিসেবে তার উচ্ছল অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ২০২২–এর বিশ্বকাপ এ–ও ইঙ্গিত দিয়ে গেল, বিশ্ব ফুটবল অঙ্গনে এশিয়া-আফ্রিকার প্রবল উত্থান ঘটছে। বিশ্বকাপের ছায়ায় এ–ও টের পাওয়া গেল, আরব বিশ্বের সামাজিক পরিসরে খানিক নতুন হাওয়াও বইছে। আরব মূল্যবোধ সঙ্গে নিয়েই কাতার, আরব আমিরাত ও সৌদি আরব বিশ্ব পরিসরে বড় ভূমিকা নিতে চাইছে। সামাজিক এ রূপান্তরকে এগিয়ে নিতে কাতারকে ২২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হলো।

বিশ্বকাপের পাশাপাশি বিগত বছরের বড় প্রাপ্তি ছিল মহামারির হয়রানি থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হওয়ার সুযোগ। যদিও কোভিড–১৯

একেবারে বিলীন হয়নি, কিন্তু বিধিনিষেধ অনেকটাই এখন স্মৃতি।

মৃত্যুর নিয়তি নয়, মানুষ আবার বিশ্বসংসারের লাগাম নিতে পারল। তবে এর মধ্যে শ্রেণিযুদ্ধটাও বহাল তবিয়তে আছে। ব্রাজিলে বামপন্থী লুলা দ্য সিলভার ফিরে আসা মোকাবিলা হলো একই অক্টোবরে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক কর্তৃক ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে টুইটার কিনে নিয়ে।

মাঠের লড়াই বনাম বাক্​স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের চলমান এসব সংঘাত বিশ্বজুড়ে আরও নানা চেহারায় হাজির ছিল ২০২২ সালে। ডান্ডাবেড়ি পরে জানাজা পড়তে বাধ্য হওয়াকে সেই তালিকায় ফেলা যাবে কি না, তা নিয়ে বাংলাদেশের ‘বুদ্ধিজীবী’রা অবশ্য এখনো একমত নন।

  • আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ের গবেষক