নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে চলছে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নসংক্রান্ত কার্যক্রম। সম্প্রতি রাজধানীর উদয়ন স্কুলে
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে চলছে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নসংক্রান্ত কার্যক্রম। সম্প্রতি রাজধানীর উদয়ন স্কুলে

শিক্ষায় পরিবর্তন জরুরি, তবে এগোতে হবে ধীরে

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা পর্যায়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। তবে উন্নত দেশের দিকে তাকালে আমাদের শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আবশ্যক। শিশুর মানসিক বিকাশ, চরিত্র গঠন, সৃষ্টিশীলতা, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ইত্যাদি শিক্ষার অংশ হওয়া উচিত। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষাবিদদের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা প্রয়োজন। এগোতে হবে বুঝেশুনে।

প্রথম আলোয় ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি ‘পিইসি ও জেএসসি নয়, খেলার মাঠ চাই’ শীর্ষক একটি লেখা লিখেছিলাম। বলেছিলাম, মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষানির্ভর বর্তমান স্কুলশিক্ষা কোনোভাবেই আধুনিক ধ্যানধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের জন্য আনন্দময় হওয়া প্রয়োজন। কিন্ডারগার্টেনের ধারণা ব্যাখ্যা করেছিলাম। খেলাধুলাসহ শিশুর মানসিক বিকাশ, চরিত্র গঠন, সৃষ্টিশীলতা, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ইত্যাদি শিক্ষার অংশ হওয়া উচিত। কেননা, একজন পরিপূর্ণ ও সফল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে পরীক্ষার নম্বরের চেয়ে এসব বিষয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এই লেখার পর কাকতালীয়ভাবে একের পর এক পরিবর্তন দেখতে থাকলাম। প্রথমে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাদ। তারপর নতুন শিক্ষাক্রম। বোঝা গেল, সরকার এসব বিষয় নিয়ে হয়তো কাজ করছিল। বলাবাহুল্য, পরিবর্তনগুলো নতুন কিছু নয়। মোটামুটি উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যাঁরা অল্পবিস্তর জ্ঞান রাখেন বা বিদেশে ঘুরেছেন, তাঁরা জানেন বাংলাদেশের মতো বেত দিয়ে পেটানো আর একগাদা বই মুখস্থ করা কোনো সভ্য দেশের স্কুলশিক্ষার ধরন নয়। 

শুধু আমি নই, হাজারো সচেতন নাগরিক বিষয়টি নিয়ে বরাবরই একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে আসছেন। নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের ‘ভাইরাল’ ভিডিও ক্লিপ ‘জিপিএ–৫’–এর সারমর্মও একই। অধ্যাপক জাফর ইকবালও পিইসি ও জেএসসির বিপক্ষে ছিলেন। ঢাকা কলেজে পড়াকালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বরাবরই আমাদের মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মজা করতেন। এত প্রাজ্ঞজনেরা যেখানে পুরোনো শিক্ষাপদ্ধতির সমালোচক, সেখানে পরিবর্তন তো অবশ্যম্ভাবী ছিল। তাহলে এই নতুন শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে কেন এত হইচই?

নতুন শিক্ষাক্রমে কেমন পরিবর্তন

ফিনল্যান্ডের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত পরিবর্তনের যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে দেশীয় নতুন পদ্ধতিটি বাংলাদেশে প্রচলিত ব্রিটিশ বা ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা কার্যক্রমের অনেকটা নকল বলে মনে হচ্ছে। এটাও ঠিক, ইউরোপ বা আমেরিকার দেশগুলোর স্কুলব্যবস্থা অনেকটা কাছাকাছি। বড় শহরগুলোতে আজকাল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সর্বত্র। তাদের শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই, দশম শ্রেণি বা ও লেভেলের আগে কোনো বোর্ড পরীক্ষা হয় না। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পরীক্ষা হয় যথাক্রমে এ-১ ও এ-২ নামে। পরে এগুলোর সম্মিলিত যোগফলের ভিত্তিতে দ্বাদশ তথা এ লেভেল পরীক্ষার ফল নির্ধারিত হয়।

ও কিংবা এ লেভেলে বিজ্ঞান, মানবিক কিংবা ব্যবসা বলে কোনো বিশেষ ভাগ নেই। ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়ার কোনো প্রথা নেই। ভালো স্কুলগুলোতে ব্যাবহারিক জ্ঞান, শিক্ষাসফর, উপস্থাপনা বা হাতের কাজে জোর দেওয়া হয়। ধারাবাহিক মূল্যায়ন হয় এবং তাতে পরীক্ষার ফলের পাশাপাশি অন্য গুণাবলি যেমন ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষকের মতামত সংবলিত মূল্যায়নপত্র অভিভাবককে দেওয়া হয়। ৫০ বছর ধরেই বাংলাদেশের ভালোমানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো এসব পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষাক্রম চালিয়ে আসছে। বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রমে অনেকটাই এসব ধারণা প্রবর্তন করা হয়েছে। অথচ, সমালোচকদের আন্দোলন দেখে মনে হচ্ছে, এই প্রথম তাঁরা এ ধরনের নতুন কিছু শুনেছেন।

হ্যাঁ, কিছু পার্থক্য অবশ্যই আছে। যেমন ‘ও লেভেল’ পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী ন্যূনতম যেকোনো পাঁচটি বিষয় আর ‘এ-লেভেলে’ যেকোনো দুটি বিষয় নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। বেশিও নিতে পারে। তবে বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসিতে ঐচ্ছিক বিষয়ের সেই সুযোগ না রেখে নির্দিষ্ট ১০টি বিষয় রাখা হয়েছে। 

ফিনল্যান্ডে ছয় বছর বয়সে এক বছরের জন্য প্রাক্-প্রাথমিক আর সাত বছর থেকে প্রাথমিক শুরু হয়। বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম এমনকি নামীদামি বাংলা মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্লে, নার্সারি, কেজি ওয়ান, আর কেজি টু–এর নামে একটি অবুঝ শিশুকে নিয়ে যেভাবে চার বছর স্কুলে দৌড়াতে হয়, সেটি রোধ করা গেলে ঢাকার যানজট অনেক কমে যেত।

নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক কিছুই সংযোজন করা হয়েছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। ধারাবাহিক মূল্যায়নে দুর্নীতি এবং এর ফলে কোচিং ব্যবসা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা অমূলক নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ধরন পরিবর্তন করা না হলে কোচিং ব্যবসা আরও জমজমাট হবে! হাতে-কলমে শেখাতে গেলে উপকরণ প্রয়োজন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা সমানভাবে সরবরাহ করা বড় চ্যালেঞ্জ। ফিনল্যান্ড হোক আর যুক্তরাজ্য, সেসব দেশে আমাদের মতো গ্রাম আর শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ নেই।

সমালোচনার ধরন

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমালোচনার মাত্রা ও ধরন ভিন্ন ভিন্ন। সাধারণ থেকে উচ্চশিক্ষিত—সব পর্যায় থেকেই নানা ধরনের প্রতিবাদ সমালোচনা শোনা যাচ্ছে। যেমন ‘জীবন ও জীবিকা’ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ডিমভাজি আর বিছানা গোছানো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ট্রল হচ্ছে—‘নতুন শিক্ষাক্রম কি কাজের বুয়া বানাবে?’ 

সমালোচকেরা সম্ভবত জানেন না, উন্নত দেশে কাজের বুয়া বা গাড়িচালক খুব কম মানুষের বাসায় থাকে। অধিকাংশ মানুষ নিজের কাজ নিজে করেন। কাজের লোক থাকলেও তাঁদের ছোট করে দেখা হয় না। বেতন দিতে হয় অনেক। মন্ত্রীরাও নিজের গাড়ি নিজে চালান, রান্না করে খান। খাবার কিনতে দোকানের সামনে বিল গেটসকে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার ছবি কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। টোকিওতে পাঁচ বছর থাকাকালে পাতাল রেলে হররোজ মন্ত্রীদের চলাচল করতে দেখেছি। শুনেছি, মন্ত্রীর জন্য দুই মিনিট ট্রেন দাঁড় করিয়ে রাখায় একজনের মন্ত্রিত্ব চলে গিয়েছিল। 

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের গাড়ি থামিয়ে আগে স্কুলের গাড়ি যেতে দেওয়া হয়। স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক আইন শেখাতে রাস্তায় লাইন করে নিয়ে যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র। জাদুঘর, চিড়িয়াখানা আর বোটানিক্যাল গার্ডেনে স্কুলের শিক্ষার্থীই বেশি দেখা যায়। কথায় আছে, ‘পড়ে শেখা’, ‘দেখে শেখা’ আর ‘করে শেখা’—এ তিনটির মধ্যে ‘করে শেখা’ সবচেয়ে কার্যকর, তারপর ‘দেখে শেখা’ আর সর্বশেষ ‘পড়ে শেখা’।

ইউটিউবে এক বাংলাদেশি সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অবস্থানকালে তাঁর এক সুইস বন্ধু তাঁকে জুরিখ হ্রদে সাঁতার কাটার আমন্ত্রণ জানালে, তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে, তিনি সাঁতার জানেন না। সুইস বন্ধুটি আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কি স্কুলে পড়োনি?’ অর্থাৎ স্কুলে পড়েছ, অথচ সাঁতার শেখোনি? দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও অনেককেই দেখেছি, জানেন না, ই-মেইলে ক্যাপিটাল লেটারে কোনো কিছু লেখার মানে ‘গালি দেওয়া বা উচ্চ স্বরে কথা বলা।’

‘ভালো থাকা’ নামে একটি অংশ নিয়েও  নাকি ট্রল হচ্ছে। এটি মূলত ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা’ পাঠের অন্তর্গত। শিশুর স্বাস্থ্য, আবেগ, অনুভূতি কিংবা কীভাবে সঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারে, এগুলোই শেখানো হবে এখানে। আজকাল শিশুর মানসিক বিকাশকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। তাই, পুরো বিষয় না জেনে আমাদের বক্তব্য দেওয়া ঠিক নয়। 

বিষয় বিভাজন কতটা যৌক্তিক

এ তো গেল সাধারণ মানুষের ধারণা। উচ্চশিক্ষিতদের বক্তব্য কী? নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে রীতিমতো জ্বালাময় বক্তৃতা দিচ্ছেন অনেক বিজ্ঞজন। কম বিজ্ঞান পড়িয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের টেনে নিচে নামানো আর মানবিকের শিক্ষার্থীদের কিছু বিজ্ঞান পড়িয়ে ওপরে তুলে ‘গড়পড়তা’ করার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ। এতে সম্ভবত একটি সূক্ষ্ম ভুল আছে। মানবিকে পড়া শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ে ওপরে উঠেছে, কে বলল? মানবিকে পড়েছে সে সাংবাদিক, আইনজ্ঞ বা রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার আশায়। বিজ্ঞান পড়ে তো সে নিজে বরং তাঁর নিজ বিষয়ে কিছুটা কম জ্ঞান তথা গড়পড়তায় নেমে গেল।  তবে হ্যাঁ, এসএসসিতে ১০টি আবশ্যিক বিষয় না রেখে অন্তত দুটি ঐচ্ছিক বিষয় রাখা যেত।

উদ্যোগটি সম্ভবত নেওয়া হয়েছে একে অন্যকে জানার জন্য। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আর তেমন সুযোগ পাবেন না। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান, মানবিক আর ব্যবসা—এই ধরনের বিভাজন ভালো নয়। ‘পেডাগজি’ বা শিক্ষাবিজ্ঞানে এটি আজকাল প্রায় একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণিত বিষয়। উন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও কেউ এক বিষয়ে ‘মেজর’, আরেক বিষয়ে ‘মাইনর’ করলে ভালো চোখে দেখা হয়।

সভ্যতার শুরুতে সব বিখ্যাত মনীষী সব বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন। অজানাকে জানা আর যেকোনো সমস্যার সমাধানই তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল। অ্যারিস্টটল একাধারে বিজ্ঞান, দর্শন, নীতিশাস্ত্র, সাহিত্য ও কলা, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সরকার—এসব বিষয়েই নিজের পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি একাধারে ছিলেন বিশ্বখ্যাত চিত্রকর, আবার উড়োজাহাজ তৈরির চেষ্টাও করেছিলেন। কালের পরিক্রমায় সেই ধারা বিলুপ্ত। জ্ঞানের ভান্ডার এখন এতটাই বিস্তৃত যে কেউ চাইলেও পাঁচটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে পারবেন না। গত শতাব্দীতে তাই ধরে নেওয়া হতো, ১২ ক্লাস বা কলেজ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করবে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষায়িত বিষয়ে। 

যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এই ধারণারও পরিবর্তন হয়েছে। তাঁদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্নাতক’ পর্যায়ে বিশেষায়িত বিষয়ের পাশাপাশি তাদের ‘জিইডি’ বা ‘জেনারেল এডুকেশন’–এর অনেক বিষয় পড়তে হবে। এটি নাকি একজন ডিগ্রিধারীর লব্ধ জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগে অনেক বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ ধারণা দিন দিন পরিবর্তন হচ্ছে! 

পরিবর্তনে অস্বীকৃতিও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া

আশির দশকে স্কুলের শিক্ষার্থীরা এলাকার মুরব্বিদের এড়িয়ে চলত। কারণ, দেখা হলেই একটি ইংরেজি ‘ট্রান্সলেশন’ ধরা তাঁদের অভ্যাস ছিল। যেমন ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল।’ অতঃপর তাঁদের সময়ে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা, আর বর্তমানে সব গেল গেল।। আমি নিশ্চিত, ছোটবেলায় তাঁদের বাপ-দাদারাও একই ধরনের প্রশ্ন করে মোগল আমলের শিক্ষাব্যবস্থার বড়াই করতেন। 

এই ধ্যানধারনা নাকি একটি মানসিক সমস্যা, যাতে সব বয়স্করাই কিছু না কিছু আক্রান্ত। আবার ঔপনিবেশিক মানসিকতাও এ জন্য দায়ী। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিও ক্লিপ—‘আমি জিপিএ–৫ পেয়েছি’ বাক্যের ইংরেজি জিজ্ঞাসা করা শিক্ষার্থীটি যদি বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে থাকে, তাকে কেন ‘নিউটন’ বা ‘আর্কিমিডিস’–এর সূত্র জিজ্ঞেস করা হলো না? ইংরেজি মাধ্যমের সমালোচনা করে, আবার জ্ঞান যাচাই করতে সেই ব্রিটিশ ইংরেজি! 

পরিবর্তন মেনে নিতে এই অস্বীকৃতি আসলে মানুষের স্বভাবজাত একটি অভ্যাস। আশির দশকে আমার প্রকৌশলে পড়ুয়া ভাই এক স্কুলশিক্ষককে একটি ক্যালকুলেটর দেখালে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ছেলেমেয়েরা অচিরেই অঙ্ক শেখা ভুলে যাবে। ২০০৫ সালের দিকে যখন হাতে হাতে মুঠোফোন এসেছে, তখন এক অধ্যাপককে বলতে শুনলাম, এটা খুব বিরক্তিকর। যখন-তখন বেজে ওঠে। 

একইভাবে করোনাকালে ‘অনলাইন’ শিক্ষা নিয়েও সমালোচনা বা ট্রল কম হয়নি। অথচ উন্নত বিশ্বে ২০৫০ সাল নাগাদ অবশ্যম্ভাবী ‘ভার্চু৵য়াল বিশ্ববিদ্যালয়’ ধারণার সঙ্গে কীভাবে খাপ খাওয়ানো যায়, তা নিয়ে আগাম প্রস্তুতি চলছে।

পরিবর্তন: দেশের বাস্তবতায় ধীরে

নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক কিছুই সংযোজন করা হয়েছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। ধারাবাহিক মূল্যায়নে দুর্নীতি এবং এর ফলে কোচিং ব্যবসা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা অমূলক নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ধরন পরিবর্তন করা না হলে কোচিং ব্যবসা আরও জমজমাট হবে! হাতে-কলমে শেখাতে গেলে উপকরণ প্রয়োজন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা সমানভাবে সরবরাহ করা বড় চ্যালেঞ্জ। ফিনল্যান্ড হোক আর যুক্তরাজ্য, সেসব দেশে আমাদের মতো গ্রাম আর শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ নেই।

সর্বোপরি দেশের শিক্ষাবিদদের সঙ্গে এ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা প্রয়োজন। এই নতুন শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থেরও প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর অভিপ্রায় থাকতে হবে। এ জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতেও সময় লাগবে। সুতরাং বাস্তবতার নিরিখে একটু ধীরে চলাই শ্রেয়।  

ড. মো. সিরাজুল ইসলাম অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ; পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেস, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি