দায়মুক্তির রাজনীতি যে ফল নিয়ে আসে

বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে দেখা যায়, আইন করে দায়মুক্তি দেওয়ার রাজনীতি এ দেশে নতুন কিছু নয়। দায়মুক্তির রাজনীতি ন্যায়বিচারের জন্য বাধা কি না, তা নিয়ে লিখেছেন ইমরান আজাদ

আন্তর্জাতিক আইনে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ইমিউনিটি বা অব্যাহতির ধারণা প্রচলিত আছে। রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে সংঘটিত অফিশিয়াল অ্যাক্ট বা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের কারণে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা (উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান ও মন্ত্রী) অনেক সময় মামলা-মোকদ্দমা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আদালতে প্রার্থনা করতে পারেন। 

লক্ষণীয় হলো, ব্যক্তি বিশেষকে ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব বা জবাবদিহি থেকে বাঁচানো আন্তর্জাতিক আইনের উদ্দেশ্য নয়; বরং প্রশাসনিক দায়িত্বের সুচারু সম্পাদন নিশ্চিত করতে কোনো কিছু যেন বাধা তৈরি করতে না পারে, এমন বিষয়গুলো আইন দিয়ে সুরক্ষা করার জন্যই আন্তর্জাতিক আইন শর্ত সাপেক্ষে ইমিউনিটির বিধানের কথা বলে।

  • আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ইমপিউনিটি বা দায়মুক্তি যেখানে শর্তসাপেক্ষ একটা আইনি ধারণা, সেখানে ইমপিউনিটির চর্চা একটা রাজনৈতিক বিষয়।

  • ভাষাগত ভিন্নতা থাকলেও ভাবের দিক থেকে সংবিধানের বিধানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রদত্ত ‘দায়মুক্তি’র ঘোষণার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

  • ঢালাও মামলা না করা ও আইনি হয়রানি বন্ধের কথা বলা, আবার অন্যদিকে দায়মুক্তির মতো ঘোষণা দেওয়ার ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে।

এ ধরনের ইমিউনিটির লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে সব রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বোঝাপড়া ও সমতাভিত্তিক সার্বভৌম এবং সম্প্রীতির জায়গা নিশ্চিত করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ, যেমন জেনোসাইড, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় কোনো ধরনের দায়মুক্তি প্রদানকে সমর্থন করে না। নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনাল থেকে শুরু করে হাল-আমলের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনালের মতো প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থাগুলোর কোনোটিই দায়মুক্তিসংক্রান্ত আইনি উদ্যোগকে স্বীকার করে না (দেখুন, রবার্ট ক্রায়ার ও প্রমুখ, অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ল অ্যান্ড প্রসিডিউর, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৯, চতুর্থ সংস্করণ)। 

স্মরণ করা যেতে পারে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকের চিলির স্বৈরশাসক জেনারেল অগাস্তা পিনোশের বহুল আলোচিত মামলার কথা। আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনের দায়ে সার্বভৌম রাষ্ট্রের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও ফৌজদারি অভিযোগ থেকে কোনো ধরনের অব্যাহতি পাননি পিনোশে। ১৯৭৩-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত চিলির রাষ্ট্রপতি ও একই সঙ্গে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় ব্যাপক মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা, নির্যাতন ও বেআইনিভাবে আটক রাখা।

বার্ধক্যের কারণে ১৯৯৮ সালে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর তিনি ইংল্যান্ডে চিকিৎসার জন্য যান। ইতিমধ্যে স্পেনের একটি আদালত তাঁর বিরুদ্ধে করা কিছু মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং স্পেনে প্রত্যর্পণ করার উদ্দেশ্যে লন্ডনের পুলিশ তাঁকে আটক করে। একটা দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রশাসনিক কাজের অংশ হিসেবে তাঁর কৃতকর্মের জন্য তিনি ইমিউনিটি পাবেন এই মর্মে ইংল্যান্ডের আদালতে স্পেনের আদালত কর্তৃক জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন পিনোশে। 

ইংল্যান্ডের তৎকালীন সর্বোচ্চ আদালত হাউস অব লর্ডস পিনোশের মামলাটা খারিজ করে দিয়ে তাঁকে প্রত্যর্পণ করার সিদ্ধান্ত দেন। একই সঙ্গে বলা হয়, একটা দেশের রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় তাঁর জ্ঞাতসারে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকায় ‘প্রশাসনিক কাজের জন্য ইমিউনিটি পাওয়ার’ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় এবং পিনোশে তাঁর ফৌজদারি দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত না কিংবা বিচারের সম্মুখীন হওয়া থেকে তিনি ছাড় বা ইমিউনিটি পেতে পারেন না। 

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, ইমিউনিটি যেখানে শর্তসাপেক্ষ একটা আইনি ধারণা, সেখানে ইমপিউনিটি বা দায়মুক্তির চর্চা একটা রাজনৈতিক বিষয়। রাজনৈতিক বিষয় হলেও সাধারণত ইমপিউনিটিকে আইনের বাতাবরণে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেক বাধার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে এই দায়মুক্তির রাজনীতি।

ইতিহাস বলে, দায়মুক্তির রাজনীতি ভালো কিছু বয়ে আনে না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাই প্রত্যাশা রইল, দায়মুক্তির পরিবর্তে ফাটল ধরা এই সমাজে সত্যানুসন্ধান ও সুবিচার নিশ্চিত করুন। এর মাধ্যমেই সামাজিক সংস্কারের এক নতুন ভিত্তি স্থাপন হবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আদেশ জারি করে জানিয়ে দিয়েছে যে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান–সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না। সুনির্দিষ্টভাবে ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংগঠিত গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ঘটনাগুলোকে মাথায় রেখে এরূপ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে (প্রথম আলো অনলাইন, ১৪ অক্টোবর ২০২৪)। 

মোটাদাগে এ ধরনের উদ্যোগকে আইনশাস্ত্রে আমরা ‘দায়মুক্তি’ বলে থাকি। মিথ্যা মামলা দিয়ে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা তথা আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে অযথা হয়রানি করা আমাদের সংবিধান, এমনকি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও অনুমোদন করে না। তবে কোনো মামলা করা হবে না, এ রকম ঘোষণাটা মোটেই ফৌজদারি আইন তথা মানবাধিকারসংক্রান্ত সাংবিধানিক আইনের কাঠামোতে গ্রহণযোগ্য নয়। একই সঙ্গে এ ধরনের ‘দায়মুক্তি’র রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার যে ধরনের সংগ্রাম, সাধারণ মানুষের আত্মদান ও নাগরিক ম্যান্ডেটের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে, সেটাকেও ধীরে ধীরে জনপরিসরে মলিন করে ফেলতে পারে।

এই দায়মুক্তি আদেশের কিছুদিন আগে থেকেই পতিত স্বৈরাচারী সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়েছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির অভিভাষণ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে ‘আমরা প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা ঢালাও মামলা, বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করা, মানুষের জীবন-জীবিকাকে নিশ্চিহ্ন করা, মানুষের মধ্যে ক্রমাগত ক্ষত, ক্রোধ, ক্রন্দন সৃষ্টি করা থেকে বের হতে চাই।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪)

বিগত স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক আইন ও বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে দিনের পর দিন ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করা হয়েছে তাঁর সমালোচনা করতে গিয়েই আইন উপদেষ্টা মূলত এই কথাগুলো বলেন। তবে একদিকে ঢালাও মামলা না করা ও আইনি হয়রানি বন্ধের কথা বলা, আবার অন্যদিকে দায়মুক্তির মতো ঘোষণা দেওয়ার ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি, সদ্য ঢাকা সফর করে যাওয়া জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের বক্তব্যে।

সফরের শেষ দিনে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়াকে অবশ্যই টেকসই হতে হবে। এ জন্য ৫ আগস্টের আগে-পরে হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করতে হবে। দলবদ্ধ সহিংসতা ও যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ডের দায়মুক্তি জাতিসংঘ সমর্থন করে না।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ৩১ অক্টোবর ২০২৪)

ছাত্র-আন্দোলনের সময় বিভিন্ন স্থানে পুলিশ হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্রীয় দায়মুক্তির বিষয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে হাইকমিশনার টুর্ক বলেন যে হত্যার ধরন বা কারণ যা–ই হোক না কেন, দায়মুক্তি কখনো কাম্য নয়। প্রতিটি হত্যার তদন্ত ও বিচার করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশে মানবাধিকার বিষয়টি নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে দায়মুক্তির এ রকম উদ্যোগ কি এই প্রথমবারের মতো কোনো ঘটনা? ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশে আইন করে দায়মুক্তির ধারা শুরু ও চলমান রাখা হয়েছে।

প্রথমেই দেখা যাক বাংলাদেশের সংবিধান এ বিষয়ে কী বলে। দায়মুক্তি বিষয়ে আমাদের সংবিধানের ৪৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে যে সংবিধানে মৌলিক অধিকার নামে যা-ই স্বীকৃত থাকুক না কেন, তা সত্ত্বেও ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের’ অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে বা দেশের ঘোষিত রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যেকোনো অঞ্চলে শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের উদ্দেশ্যে সংঘটিত কর্মকাণ্ডের জন্য সংসদ আইন প্রণয়ন করে দায়মুক্তি দিতে পারবে।

ভাষাগত ভিন্নতা থাকলেও ভাবের দিক থেকে সংবিধানের এই বিধানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রদত্ত দায়মুক্তির বিধানের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সংবিধানে মূলত এই বিধান যুক্ত করা হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আইনি নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। এতে দুটি ঘটনা ঘটে।

প্রথমত, সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অংশটুকুকে খর্ব করে দায়মুক্তির বিধানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, যা সাংবিধানিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পুরোপুরি পরিপন্থী। 

দ্বিতীয়ত, সংবিধানের দায়মুক্তির বিধানের কারণে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত থাকা বাহিনীগুলোর বা কোনো কোনো সদস্যের যুদ্ধকালীন অপরাধমূলক আচরণ–সংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনের মানদণ্ডে কখনোই হয়নি।

মনে রাখা দরকার, আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা (যেমন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক আক্রমণ বা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা) অনুমোদনযোগ্য হলেও যুদ্ধকালীন বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা বা নির্বিচার হত্যাকাণ্ড-আক্রমণ চালানো কোনোভাবেই স্বীকৃত নয়; বরং আন্তর্জাতিক আইনে তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। 

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ অবশ্য কোনো কিছু করার আগেই ১৯৭৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সংঘটিত কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো ধরনের মামলা করা যাবে না বলে ঘোষণা দেন।

১৯৭৩ সালের দ্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল লিবারেশন স্ট্রাগল (ইনডেমনিটি) অর্ডার নামের এই আইন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০ এবং চতুর্থ তফসিল অনুযায়ী একটি সংরক্ষিত আইন। অর্থাৎ অন্যান্য বিধানাবলি যেমন আইনের দৃষ্টিতে সমতা (অনুচ্ছেদ ২৭), আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩১), বিচার প্রাপ্তির অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৫) ইত্যাদি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সংবিধান নিজেই এই আইনের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, এই আইনি কাঠামোর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল (প্রথম আলো অনলাইন, ১৮ অক্টোবর ২০২৪)।

সামরিক অভ্যুত্থানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হন। এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর তদানীন্তন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স ঘোষণা করে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করার পথ বন্ধ করে দেন। পরবর্তী সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে এই আইনকে বৈধতা দেন (সংবিধানের সপ্তম পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এই আইনকে বিলুপ্ত করে দিয়ে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া চালু করে।

২০০১ সালে চারদলীয় বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাস দমন ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মাধ্যমে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে মাঠে নামায়। ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি সময়ের মধ্যে ‘অপারেশন ক্লিন হার্টের’ মাধ্যমে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করার নামে যৌথ বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বিচারবহির্ভূত কার্যক্রম তথা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর যেন কোনো বিচার না হয়, সে জন্য ২০০৩ সালে যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন নামে আগের সরকারগুলো মতো দায়মুক্তির মতো একটি কালো আইন পাস করে। আইনজীবী জেড আই খান পান্নার করা এক জনস্বার্থের মামলা শুনানি শেষে ২০১৫ সালে উচ্চ আদালত এই আইনটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। 

সংসদে আইন করে দায়মুক্তি দেওয়ার ধারাবাহিকতা গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলেও দেখা গেছে । বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কুইক রেন্টালের নামে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বাবদ বিপুল পরিমাণ দেশের অর্থ বাইরে পাচার করা হয়েছে। দুর্নীতির এই মহাযজ্ঞ সরকার পতনের আগপর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা আইন করে দায়মুক্তি দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে দেখা যায়, আইন করে দায়মুক্তি দেওয়ার রাজনীতি এ দেশে নতুন কিছু নয়। তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের দায়মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা হতাশাব্যঞ্জকই বটে। তবে দায়মুক্তির প্রক্রিয়াটি নিশ্চিতভাবে ঘটবেই কি না, তা এখনো চূড়ান্ত নয়। সরকারের গাঠনিক তর্ক-বিতর্কের সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি এবং দায়মুক্তি ব্যাপারটার রাজনৈতিক পরম্পরার কারণে মনে হচ্ছে, এই সরকার ও সরকার–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হয়তো নিজেদের মেয়াদ পরবর্তী সময়ের জন্য আইনি সুরক্ষার পাওয়ার লক্ষ্যেও দায়মুক্তি প্রাপ্তির চেষ্টা করবেন। 

ইতিহাস বলে, দায়মুক্তির রাজনীতি ভালো কিছু বয়ে আনে না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাই প্রত্যাশা রইল, দায়মুক্তির পরিবর্তে ফাটল ধরা এই সমাজে সত্যানুসন্ধান ও সুবিচার নিশ্চিত করুন। এর মাধ্যমেই সামাজিক সংস্কারের এক নতুন ভিত্তি স্থাপন হবে।

ইমরান আজাদ, সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস