ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়

হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি ছিল মূলত গদি টেকানোর হাতিয়ার

গণভবন লক্ষ্য করে বিক্ষুব্ধ জনতা রওনা হওয়ার পর হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়াটা মোটেও আশ্চর্যের বিষয় ছিল না। এর কারণ বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সরকারের মধ্যে গভীর পচনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়েছিল। বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক অলৌকিক ঘটনা’ অনেক মানুষকে চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছিল বটে, কিন্তু সেই সাফল্যের বন্দনাগীতি শেষ পর্যন্ত তিক্ত হতে শুরু করেছিল।

জাতীয় নির্বাচনে হাসিনার কারসাজি, জনগণের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব করা এবং প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন নিয়েও হতাশা বাড়ছিল। যে পৃষ্ঠপোষক চক্রগুলো ক্রমবর্ধমান অজনপ্রিয় স্বৈরশাসককে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল তাদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল।

বিরোধী দল বিএনপি ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করার পর একতরফা ভোটে হাসিনার আওয়ামী লীগ বিশাল জয় পায়। কিন্তু এই একতরফা ভোটের পর জনমনে যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল তা আওয়ামী সরকার ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল।

হাসিনার পতনের পর অসাধারণ গতিতে সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে আলোচনার পর নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। নির্দলীয় ব্যক্তিত্ব ও সততার জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ইউনূস ইতিপূর্বে বহুবার হাসিনা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশের ভেতরে এখন মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অস্বস্তি এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশাবাদের মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। অনেকে আশা করছেন, ইউনূস গণতন্ত্র পুনর্গঠনের জন্য রাজনৈতিক সংস্কারে নেতৃত্ব দেবেন। এর মাধ্যমে তিনি অর্থনীতিকে আবার ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারবেন এবং অন্য কোনো স্বৈরশাসকের উত্থান রোধ করতে পারবেন। নতুন সরকারের সামনে এটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।

অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার পাশাপাশি ইউনূসকে পররাষ্ট্রনীতির দিকে মনোযোগী হতে হবে। বাংলাদেশকে এখন সবচেয়ে বেশি কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখতে হবে যে দেশটির সঙ্গে, সেটি হলো তার প্রতিবেশী ভারত। কারণ বাংলাদেশে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটে গেছে তার ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারে ছিল।

হাসিনাকে গত ১৫ বছর ধরে নয়াদিল্লি একচেটিয়াভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে এবং তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দিল্লিতেই আশ্রয় নিয়েছেন। একজন অজনপ্রিয় নেতার প্রতি নয়াদিল্লির কট্টর সমর্থন ইতিমধ্যে ভারতকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে এবং বাংলাদেশে আগে থেকে বিদ্যমান ভারতবিরোধী মনোভাব ভারতকে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল প্রধানত তাঁর শাসনক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার একটি হাতিয়ার। কিন্তু ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এখন সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য নীতি পুনর্নির্ধারণ ও অগ্রসর করার। সেই সুযোগ তাদের কাজে লাগাতে হবে।

এ কারণে ভারতকে এখন সাবধানে পা ফেলতে হবে এবং এমন কোনো ধারণা তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে হবে যা অন্তর্বর্তী সরকার এবং বাংলাদেশি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ক্ষুণ্ন করে। অনেক ভারতীয় ভাষ্যকার হাসিনার পতনের জন্য বিদেশি হস্তক্ষেপকে দায়ী করেছেন; কেউ কেউ এমন দাবিও করেছেন যে, ভূ-রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ‘অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে’।  

চীনের উত্থানের কারণে বাংলাদেশ একটি ভূরাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এসব দিক মাথায় রেখেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভারসাম্য রেখে চলছিলেন। পশ্চিমা দেশগুলো সাধারণত ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার না দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের গণতান্ত্রিক ত্রুটি, দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে এসেছে। অনেকে মনে করেন, তাদের এই উপেক্ষা হাসিনাকে স্বৈরাচারী হতে উৎসাহিত করেছে। কারণ তাদের নীরবতা তাঁকে বেপরোয়া করে তুলেছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিনের বেশি হবে বলে ধরে নিলে পশ্চিমারা মুহম্মদ ইউনূসকে হাসিনার সঙ্গে লড়াইয়ে নামা নেতার বদলে একজন স্বাভাবিক অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে। এই ধারণা ইউনূসকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কাজকে নিতে সহায়তা করবে এবং দাতাদের পক্ষেও ইউনূসের প্রযুক্তিগত বা আর্থিক সহায়তার যে কোনো যুক্তিসংগত অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা কঠিন হবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তৈরি পোশাক খাতের প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক রাখাও অপরিহার্য।

একই সঙ্গে ইউনূস সম্ভবত পশ্চিমের ওপর খুব বেশি নির্ভর করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা উচিত হবে। ধারনা করি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখার পাশাপাশি ঢাকা তার নিজস্ব অঞ্চলেও সম্পর্ক গড়ে তুলবে। চীন এবং জাপানের মতো বড় উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের অবকাঠামোগুলো ঠিক করতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের মধ্যে স্বল্পমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ইউনূস আর্থিক সহায়তার সন্ধান করবেন।

ভারতের ওপর হাসিনার ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা চীনকে হতাশ করেছিল। বিশেষ করে মোংলা বন্দরের ব্যবস্থাপনা এবং তিস্তা প্রকল্পের মতো কিছু বড় প্রকল্পে চীনা কোম্পানিকে হটিয়ে ভারতের কোম্পানিগুলোর কাজ পাওয়া চীনের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছিল। গত জুলাই মাসে শেখ হাসিনা বেইজিং সফরে যাওয়ার পর সেখানে চীন সরকার তাদের অসন্তোষ স্পষ্ট করেছিল। হাসিনার প্রত্যাশা ছিল চীন কয়েক বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা দেবে। কিন্তু চীন তাতে অস্বীকৃতি জানায় যা হাসিনাকে সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে আসতে প্ররোচিত করে।

অবশ্য এখানকার ভূরাজনীতি বিবেচনায় নিলে ভারত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবেই থাকবে। নয়াদিল্লি নতুন বাস্তবতাকে মাথায় নিলে ঢাকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে না পারার কোনো কারণ নেই।

ভারত আওয়ামী লীগের বাইরে অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনীতির মাঠে নতুনভাবে শক্তি নিয়ে ফেরা বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হওয়ার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

ভারত বাংলাদেশের বিরোধী দলকে তার স্বার্থের বিরোধী শক্তি হিসাবে দেখে আসলেও বিএনপি সম্ভবত বৃহত্তর সম্পৃক্ততার জন্য উদার থাকবে। ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি নয়াদিল্লিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে তারা ভারতের জন্য কোনো হুমকি নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের বাইরে বিএনপির সঙ্গে কাজের সম্পর্ক স্থাপন করা ভারতকে আরও ভালো অবস্থানে আনবে।  

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক নীতির চ্যালেঞ্জ হবে মিয়ানমার। সেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্যের এলাকাগুলো দখল করেছে। রাখাইন থেকে উচ্ছেদ হওয়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় দিয়েছে।

গত তিন বছরে মিয়ানমারের পরিবর্তনকে মাথায় রেখে বাংলাদেশকে জরুরিভাবে মিয়ানমার বিষয়ে নিজস্ব নীতি তৈরি করতে হবে। এটি করতে না পারলে রোহিঙ্গাদের আরেকটি বড় আগমন দেখা যেতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি আরাকান আর্মির সঙ্গে বৃহত্তর সম্পৃক্ততার কথা বলেছেন। এটি বাংলাদেশের সম্ভাব্য নীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল প্রধানত তাঁর শাসনক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার একটি হাতিয়ার। কিন্তু ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এখন সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য নীতি পুনর্নির্ধারণ ও অগ্রসর করার। সেই সুযোগ তাদের কাজে লাগাতে হবে।

নিক্কেই এশিয়া থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
টমাস কিন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বিষয়ক আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র পরামর্শক।