মতামত

নগদ অর্থসহায়তা যেভাবে বিশ্বকে বদলে দিতে পারে

টোগোর একটি প্রকল্পে কয়েক লাখ প্রাপকের কাছে ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিতরণ করা হয়
ছবি: সংগৃহীত

এ কথা সত্যি, চরম দারিদ্র্য দূর করার ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা হলেও অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছি। কিন্তু এখনো মূল লক্ষ্য থেকে আমরা বহু দূরে রয়েছি। এখনো এই পৃথিবীর অন্তত ৭০ কোটি মানুষ দৈনিক ২.১৫ ডলারের কম আয় দিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। 

আশার কথা, বিগত দশকগুলোতে দারিদ্র্য নিরসনে আমাদের হাতে কার্যকর কোনো হাতিয়ার না থাকলেও এখন আমাদের হাতে একটি লাগসই হাতিয়ার আছে। আর সেই হাতিয়ার হলো: চরম দরিদ্র পরিবারগুলোর হাতে সরাসরি নগদ অর্থসহায়তা পৌঁছে দেওয়া। 

ধারণাটি যে একেবারে নতুন, তা মোটেও নয়। জরুরি মুহূর্তে নগদ অর্থসহায়তা যে খুবই কার্যকর, সেটি ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় পৃথিবীর প্রতি ছয়জনের একজন নগদ অর্থসহায়তা পেয়েছে। তখনই দেখা গেছে, সরাসরি নগদ অর্থসহায়তা ব্যক্তির নিজের জীবনের ভালোমন্দ দেখভালের এবং নিজের পরিবারের উন্নতির জন্য সক্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। 

নগদ অর্থ হস্তান্তরের ইতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব কেউ অস্বীকার করে না। ইতিমধ্যে ৩০০টির বেশি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, চরম দরিদ্র মানুষের হাতে সরাসরি নগদ অর্থসহায়তা দেওয়ায় তাদের আয়ের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে; তাদের মধ্যে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির পরিমাণ এবং উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়েছে; অভুক্ত থাকা, অসুস্থ থাকা এবং অবসাদের কবলে পড়াসহ পারিবারিক সহিংসতা অনেক কমেছে। 

হতদরিদ্র মানুষের কাছে পরীক্ষামূলকভাবে নগদ অর্থসহায়তা দিয়ে দেখা গেছে, নগদ অর্থ হাতে পেয়ে তারা প্রতিদিন রোজগারের জন্য যতটা পরিশ্রম করে, সেই পরিশ্রম কমায়নি। হাতে বাড়তি নগদ অর্থ পাওয়ার পর তারা বিলাসিতা করে তামাক কিংবা অ্যালকোহলের পেছনে পয়সা খরচ করেছে, এমনটাও হয়নি। 

আশার কথা হলো, যেসব স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রতিদিন মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই ডলারের আশপাশে থাকে, সেখানে দরিদ্র মানুষের হাতে এক ডলার করে নগদ সহায়তা দিলে তার ব্যাপক প্রভাব গোটা অর্থনীতিতে পড়ে।

দেখা গেছে, টানা তিন বছর কোনো স্থানে এভাবে নগদ অর্থসহায়তা দিয়ে গেলে সহায়তা গ্রহণকারী আগের চেয়ে অনেক ভালো উপার্জন করেন এবং আগের চেয়ে ওই এলাকায় শিক্ষার হার অনেক ভালো হয়ে থাকে। 

কেনিয়ায় চালানো সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে ৫০০ ডলারের নগদ থোক সহায়তা স্থানীয় দরিদ্র মানুষের আয় উৎপাদনকারী মূলধন জোগাড় করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। 

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষের হাতে সরাসরি নগদ অর্থসহায়তা তুলে দেওয়ার মতো প্রযুক্তি এখন আমাদের হাতে এসে গেছে। নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি অর্থ স্থানান্তরের খরচ নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দিয়েছে এবং বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরাপদে অর্থ পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে আমাদের ক্ষমতাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। 

কোভিড মহামারির সময় আফ্রিকার দেশ টোগোতে সত্যিকার অর্থে ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য তথা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা লোকদের শনাক্ত করতে এবং তাদের হাতে নগদ অর্থ তুলে দিতে দেশটির সরকার মোবাইল ফোনের ডেটা ও স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছিল। দেশটির নোভিস্সি নামের একটি প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র মানুষকে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। 

ওই প্রকল্পের আওতায় প্রাপকদের পরিচয় যাচাই করতে এবং তাদের কাছে অর্থ পৌঁছে দিতে এসএমএস টেক্সট মেসেজিংয়ের অনুরূপ সব মোবাইল ডিভাইসে মৌলিক ইউএসএসডি (আনস্ট্রাকচারড সাপ্লিমেন্টারি সার্ভিস ডেটা) প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। এভাবে তারা ৯ লাখ ২০ হাজার প্রাপকের কাছে ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার মোবাইল মানি ট্রান্সফার পদ্ধতিতে বিতরণ করেছে। 

টোগোর এই সফল পাইলট প্রকল্প নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর এখন বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ১০ কোটি ডলারের প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে ভারত মাত্র ছয় বছরের মধ্যে তার ১৩০ কোটি মানুষকে ডিজিটাল আইডি সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে এসেছে। এটি ডিজিটাল পেমেন্টের হার বাড়িয়েছে এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নির্বিঘ্নে নগদ অর্থ পাঠানোকে সহজ করেছে। 

এখন যেহেতু টোগোর এবং অন্যান্য অনেক দেশের অনেক প্রকল্প নগদ অর্থ স্থানান্তরের কার্যকারিতা দেখিয়েছে, সেহেতু প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে এই সমাধান সূত্রের বিশ্বায়ন ঘটানো যায়। 

একটি আন্তর্জাতিক ওয়ার্কিং গ্রুপের সঙ্গে আমরা কাজ করেছি। সেই কার্যক্রমের অন্তর্দৃষ্টির আলোকে আমরা একটি নতুন বৈশ্বিক তহবিল গঠনের প্রস্তাব করছি। এই তহবিল থেকে চরম দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যে অতি দরিদ্র লোকদের কাছে সরাসরি অর্থ হস্তান্তর করা যাবে। 

এই ব্যবস্থা চালু করলে বিভিন্ন দেশ ডিজিটাল উপায়ে নগদ অর্থ স্থানান্তরের ব্যবহারকে প্রসারিত করতে পারবে। এতে বিদ্যমান সামাজিক-সুরক্ষা প্রোগ্রামগুলো প্রসারিত হবে। এইডস, যক্ষ্মা এবং ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সমাজহিতৈষী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকারগুলো যেভাবে সম্মিলিতভাবে তহবিল গঠন করে থাকে, একইভাবে এই তহবিলের অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হতদরিদ্র মানুষ সরকারের দিক থেকে যেসব সুবিধা পেয়ে থাকে, এই নগদ অর্থসহায়তাকে সেগুলোর সম্পূরক সহায়তা হিসেবে দেখা হবে না বরং এটিকে একটি পরিপূরক সহায়তা হিসেবে দেখা হবে। এই প্রথম বিশ্বের হাতে দরিদ্রদের জন্য একই সঙ্গে অর্থ এবং সেই অর্থ সরাসরি দরিদ্রদের হাতে পৌঁছানোর পদ্ধতি এসেছে। এখন দরকার শুধু সদিচ্ছার। 

সিনা লসন টোগোর ডিজিটাল অর্থনীতি ও ডিজিটাল রূপান্তরবিষয়ক মন্ত্রী

ররি স্টুয়ার্ট দরিদ্র মানুষের কাছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থসহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত অলাভজনক আন্তর্জাতিক সংস্থা গিভডাইরেক্টলি’র একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ