‘আমি এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ২০৪৭ সালে যখন আমার দেশ স্বাধীনতার ১০০ বছর উদ্যাপন করবে, তখন তা হবে উন্নত ভারত।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২৩ সালে দেশটির স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে এ কথা উচ্চারণ করেছেন। যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, তাঁর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি বাস্তবায়নযোগ্য? উত্তর হলো, হ্যাঁ। এরপর এ প্রশ্নও আসতে পারে, এটা কি যুক্তিসংগত? উত্তর হলো, না।
তারপরও বলতে হয়, ওই সময়ে গিয়ে ভারত একটি পরাশক্তি হয়ে উঠতেই পারে একটি মাপকাঠিতে। আর তা হলো, দেশটির অর্থনীতির আয়তন যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুবৃহৎ আকার ধারণ করে। তাহলে ভারত কীভাবে সেখানে গিয়ে পৌঁছবে? দেশটিকে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে? ভারতের এই অর্জন বিশ্বের জন্য কী বয়ে আনবে?
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ ও কনজ্যুমার ইউনিটি অ্যান্ড ট্রাস্ট সোসাইটি (কাটস) ভারতের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমি এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছি। আমি সেখানে উচ্চ আয়ের দেশ হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারতকে তুলনা করেছি গ্রিসের সঙ্গে—যে দেশটিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ‘অগ্রসর’ (অ্যাডভান্সড) হিসেবে কাতারভুক্ত করেছে, যদিও এই কাতারে দেশটি দরিদ্রতম।
২০২৩ সালে ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) নিরিখে ভারতের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গ্রিসের এক-চতুর্থাংশের সামান্য নিচে। যদি গ্রিসের মাথাপিছু আয় নামমাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ হারে বাড়ে (১৯৯০-২০২৯ প্রবণতা, আইএমএফের পূর্বাভাস) আর একই সময়ে যদি ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বাড়ে, তাহলে ২০৪৭ সালে গিয়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে সেই সময়ে গ্রিসের ৬০ শতাংশ।
যদি ভারতকে গ্রিসের সমপর্যায়ের মাথাপিছু আয় অর্জন করতে হয়, তাহলে তাকে বছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তে হবে। চীন ১৯৯০ থেকে ২০১২ সময়ে যে বিস্ময়কর বার্ষিক ৯ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, তার চেয়ে কিন্তু এই ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হার খুব কম নয়।
ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচন আমাকে আরও বেশি আশাবাদী করেছে। দেশটির অবশ্যই একটি স্থিতিশীল সরকার দরকার। কিন্তু মোদির বিজেপি কিছুটা হতমান হয়েছে। আমি আশা করি, এটা সরকারকে ভারতের অত্যন্ত নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে লড়াইয়ের চেয়ে অর্থনীতি ও জনগণের কল্যাণের দিকে অধিকতর নজর দিতে উৎসাহিত করবে। বিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্য ভারত একটি প্রভাবশালী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হতে পারে। আমরা অবশ্যই আশা করব যে তা হবে।
আবার সামগ্রিক আয়তনের ক্ষেত্রে ছবিটা অন্য রকম। জাতিসংঘের পূর্বাভাস বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ভারতের জনসংখ্যা হবে ১৬৭ কোটি, যখন চীনেরটা হবে ১৩২ কোটি আর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮ কোটি। চার গুণ বেশি জনসংখ্যা নিয়ে ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমান আকারের অর্থনীতি হওয়া কঠিন কিছু হবে না। এমনকি ভারত যদি ২০৪৭ পর্যন্ত বার্ষিক ৫ শতাংশ হারেও প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, যা ১৯৯০-২০২৯ সময়ের বার্ষিক গড় হার ৬ দশমিক ৩০ শতাংশের নিচে, তাহলেও পিপিপির ভিত্তিতে ভারতের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের সমান হয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রযুক্তিগতভাবে অনেক অগ্রসর এবং দেশটির উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি। ভারতের শিল্পোৎপাদনের সক্ষমতাও চীনের সমকক্ষ হওয়া থেকে অনেক দূরে। জিডিপিতে চীনের তুলনায় ভারতের শিল্প খাতের হিস্যা শুধু কমই নয়, বরং সম্প্রতি তা কমতে শুরু করেছে। তবে আকার একটা ব্যাপারও বটে। বিপুল জনগোষ্ঠী ও সুবিশাল অর্থনীতি নিয়ে ভারত একটি পরাশক্তি হবে, যা পুরোপুরি চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্যায়ের হবে না, তবে প্রশ্নাতীতভাবে বিশাল শক্তি হয়ে উঠবে।
কী কারণে এই পরাশক্তি হয়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হতে পারে? একটি কারণ হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি, যার কথা আইএমএফের চলতি বছর এপ্রিলের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে বলা হয়েছে।
চীনের অর্থনীতির নিম্নগতি, জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনের উপাদানসহ এই কাঠামোগত শ্লথগতির প্রভাব ও মাত্রা খুব খারাপের দিক মোড় নিতে পারে ট্রাম্পের সংরক্ষণবাদী নীতির কারণে, যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। দীর্ঘ মেয়াদে জলবায়ুগত সংকট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে আর তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারে জনকল্যাণকে।
পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বাধলে কী হবে, তা তো কল্পনাই করা যায় না। এ অবস্থায় অনেকেই আশাবাদী যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রজ্বলিত করবে। এই আশাবাদ প্রশ্নসাপেক্ষ।
ভারতীয়দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অন্তত দ্বিগুণ হারে বাড়াতে হবে। তার মানে হলো, দেশটির রপ্তানিকে অন্তত বৈশ্বিক উৎপাদনের দ্বিগুণ হারে বাড়তে হবে, যেন বাণিজ্য-জিডিপি অনুপাত কমে যায়। এটি কমে গেলে অর্থনীতি আরও আবদ্ধ হয়ে পড়বে।
সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও অরবিন্দ সুব্রাহ্মনিয়াম সম্প্রতি এক গবেষণাপত্রে দেশটিতে বাণিজ্যবিমুখতা ফিরে আসার বিষয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, প্রচলিত বিশ্বাস হলো, ‘ভারত একটি অনেক বড় দেশ, যার বাজারও অনেক বড়।’ কিন্তু বাণিজ্যযোগ্য পণ্য ও সেবার জন্য সত্যিকারের বাজারের আয়তন জিডিপির ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ, আর তা মূলত দেশটিতে ব্যাপক দারিদ্র্যের কারণে।
আবার অনেকে যুক্তি দেন, ‘ভারতের প্রবৃদ্ধির জন্য রপ্তানি অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
অথচ রপ্তানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আমদানির ব্যয় মেটানো হয়, প্রতিযোগিতা বাড়ে এবং বৈশ্বিক জানাশোনার সুযোগ হয়। সর্বোপরি অনেকে বলছেন, ‘বৈশ্বিক সুযোগ সংকুচিত হয় পড়ছে।’ কিন্তু বৈশ্বিক পণ্য রপ্তানিতে ভারতের হিস্যা ২০২২ সালে ছিল মাত্র ২ দশমিক ২০ শতাংশ, যেখানে চীনের এই হার ১৭ দশমিক ৬০। এমনকি সেবা খাতের রপ্তানিতেও ভারতের হিস্যা মাত্র ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের হার যথাক্রমে ১২ দশমিক ৮০ ও ৬ শতাংশ।
মনে রাখতে হবে, ভারতের শক্তি-সামর্থ্য আছে। ভারত অনিবার্যভাবে ‘চীন ও আরেকটি’ (চায়না প্লাস ওয়ান)—এই ধারণার বিশ্বে ‘আরেকটি’ দেশ (চীন থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে অন্যান্য দেশে নিয়ে এসে বা শুধু চীনে বিনিয়োগ না করে চীন–নির্ভরতার ঝুঁকি কমানোর ধারণা হলো ‘চায়না প্লাস ওয়ান’।)
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক রয়েছে, যা দেশটির জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি এটা অন্য সবার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফ যেটাকে বলছে বিশ্ব অর্থনীতির ‘সংযোগকারী দেশ’, ভারত সেটা হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত ভারত অভ্যন্তরীণভাবে তো বটেই, বৈশ্বিকভাবেও বাণিজ্য উদারীকরণে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং দেওয়া উচিতও।
ভারতের আরেকটি বড় সুবিধা হলো দুনিয়াজুড়ে এর অভিবাসী, যাঁরা খুবই প্রভাবশালী, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে। তা ছাড়া ভারতের মানবসম্পদ দেশটির অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা ও উন্নয়ন ঘটানোর সামর্থ্য তৈরি করেছে। তাই এটাকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। সংক্ষেপে বললে, আয়তন দেশটির ভার বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ অবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভারত কীভাবে নিজেকে সামলাবে ও চালাবে। এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো অভ্যন্তরীণ—স্থিতিশীলতা বজায় রাখা; শিক্ষার মান উন্নয়ন করা; আইনের শাসন রক্ষা; অবকাঠামোর উন্নতি সাধন; বিনিয়োগের জন্য প্রথম শ্রেণির পরিবেশ তৈরি; অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ উৎসাহিত করা এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানির দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া।
ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচন আমাকে আরও বেশি আশাবাদী করেছে। দেশটির অবশ্যই একটি স্থিতিশীল সরকার দরকার। কিন্তু মোদির বিজেপি কিছুটা হতমান হয়েছে। আমি আশা করি, এটা সরকারকে ভারতের অত্যন্ত নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে লড়াইয়ের চেয়ে অর্থনীতি ও জনগণের কল্যাণের দিকে অধিকতর নজর দিতে উৎসাহিত করবে। বিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্য ভারত একটি প্রভাবশালী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হতে পারে। আমরা অবশ্যই আশা করব যে তা হবে।
মার্টিন উলফ, ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রধান অর্থনৈতিক ভাষ্যকার
ইংরেজি থেকে নেওয়া, অনুবাদ: আসজাদুল কিবরিয়া