ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়া ইউরোপে আর কোনো যুদ্ধ হবে না। যাহোক, এই ভবিষ্যদ্বাণীর তখনই সত্যি হবে, যদি রাশিয়ার দিক থেকে আসা আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা ন্যাটোর থাকে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে, রাশিয়াকে প্রতিহত করার সামর্থ্য ন্যাটোর কতটা, তা নিয়ে সংশয় বাড়ছেই।
ন্যাটো যদি নিজের প্রতিরক্ষা পুনরুদ্ধার করতে আত্মবিশ্বাসী না হয়, তাহলে সংস্থাটির উচিত রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করা। কিন্তু সেটা ইউরোপের কৌশলনীতিগত মানচিত্র বদলে দেবে। বর্তমানে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তাতে করে ন্যাটো সম্প্রসারণবাদী জোট। যদিও ন্যাটো প্রতিরক্ষামূলক জোট হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর ন্যাটো তার অবস্থান পাল্টে ফেলে। নীতিনির্ধারকেরা বাল্টিক দেশগুলোতে ও পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। রাশিয়া সে সময় ভয়াবহভাবে দুর্বল ও গরিব হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে ন্যাটোর সিদ্ধান্তটি ছিল সাহসী। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর প্রায় এক দশক রাশিয়া কোনো অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন করেনি। অর্থসংকটের কারণে নতুন অস্ত্র উৎপাদনের পরিকল্পনা তারা সরিয়ে রাখে।
ভ্লাদিমির পুতিনের শাসনামলে রাশিয়ার ক্ষয়িষ্ণু সামরিক শক্তি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। কিন্তু সেটা খুব সহজ কাজ ছিল না। কেননা রাশিয়ার সমরশিল্প আধুনিক সমরশিল্প থেকে অনেক দূর পিছিয়ে ছিল। তারা যে কাজটি ভালো করেছিল, সেটা হলো সামরিক শীর্ষ নেতৃত্বের কাউকে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র কারখানাগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি গোলাবারুদ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি কারখানা আইওয়া ও পেনসিলভানিয়ায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলোর পক্ষে উৎপাদন বাড়ানো খুবই কঠিন। কারণ হলো, তারা পুরোনো উৎপাদনপদ্ধতি ব্যবহার করে। আর কাজের পরিবেশ কঠোর হওয়ার কারণে অনেকেই সেখানে কাজ করতে চান না। যুক্তরাষ্ট্রের এই কারখানাগুলো ৮০ বছরের বেশি পুরোনো।
যাহোক, রাশিয়া আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমরশিল্প খুব ধীরে ধীরে আত্মস্থ করে নিতে থাকে। ২০২০ সালে দ্বিতীয় নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধের সময় এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে রাশিয়ার সরবরাহ করা অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধকৌশল যথেষ্ট নয়। আর্মেনিয়া মূলত রাশিয়ার অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। সেই যুদ্ধে আজারবাইজানের কাছে আর্মেনিয়া ধরাশায়ী হয়েছিল।
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকটাতে দেখা গেল, ২০২০ সালের নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধের শিক্ষা রাশিয়া গ্রহণ করেনি। দেখা গেল যে স্মার্ট অস্ত্র, যেমন ট্যাংকবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র ও ম্যানপ্যাডস আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কৌশল কী হবে, সেটা তারা রপ্ত করতে পারেনি।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে রুশরা যে ড্রোন ব্যবহার করেছিল, সেগুলো পুরোনো ও খুব যাচ্ছেতাই ধরনের। এসব ড্রোন খুব সহজেই ভূপাতিত করে ফেলছিল ইউক্রেনীয় বাহিনী। রাশিয়ার শত শত সাঁজোয়া যান অ্যাম্বুশ করে ধ্বংস করেছিলেন ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা। পশ্চিমাদের সরবরাহ করা স্মার্ট অস্ত্রশস্ত্র ও একেবারে নিখুঁত সময়ের গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভর করে ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশ বাহিনীর ওপর আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু ২০২২ সালের শেষে ও ২০২৩ সালের শুরুর দিকে রুশ সেনাবাহিনী আধুনিক প্রযুক্তি ও আধুনিক কৌশল রপ্ত করে নিতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধকৌশল (এ যুদ্ধকৌশলের কারণে জনবল ও অস্ত্রবল—দুইয়ের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়) থেকে সরে এসে কার্যকর প্রতিরক্ষাকৌশল গড়ে তোলে রাশিয়া। এটি করা হয়েছিল জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনের পরিকল্পনায়।
এরপর রাশিয়া নতুন প্রজন্মের ড্রোন, কেন্দ্রীভূত পদাতিক বাহিনী ও আকাশ থেকে ফেলা মাইনের মাধ্যমে ইউক্রেনীয় বাহিনীর গতি রোধ করে দিতে থাকে। রাশিয়া এখন ইউক্রেনকে রক্তাক্ত করার কৌশল নিয়েছে। ইউক্রেনের নয়টি ব্রিগেডকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় আমেরিকান ও ইউরোপীয় উপদেষ্টারা বিষয়টি সঠিকভাবে হিসাব করতে পারেননি।
ইউক্রেন যখন রক্তাক্ত হচ্ছে, তার মানে হচ্ছে ন্যাটোর সামরিক পরিকল্পনা ত্রুটিযুক্ত। ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র খোয়া যাওয়ার ঘটনা বলে দেয়, ন্যাটোর পরিকল্পনা টেকসই ছিল না।
গোলাবারুদের ক্ষেত্রে একটা প্রধান সংকট তৈরি হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে কতটা গোলাবারুদ দরকার, সেই হিসাব করতে পারেননি ন্যাটোর পরিকল্পকেরা। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ইউক্রেনের কাছে মূলত দূরপাল্লার গোলা সরবরাহ করেছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেটা অপ্রতুল।
রাশিয়া ও ন্যাটো—দুই পক্ষই গোলাবারুদের সংকটে পড়েছে। কিন্তু রাশিয়ার তুলনায় ন্যাটোর ঘাটতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। ন্যাটো এখন গোলার সরবরাহ বাড়িয়েছে। কিন্তু ন্যাটো এখন মাসে ১ লাখ ৬৩ হাজারের বেশি গোলা উৎপাদন করতে পারছে না। রাশিয়া মাসে সাড়ে তিন লাখের বেশি গোলা উৎপাদন করছে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরায়েলে থাকা ১৫৫ মিলিমিটার গোলার মজুত থেকে গোলা নিচ্ছে। এটি বিপজ্জনক হতে পারে। কেননা উত্তর কোরিয়া যদি দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে, তাহলে প্রতিরক্ষার জন্য সিউলের কাছে পর্যাপ্ত গোলা থাকবে না। ইসরায়েলে থাকা ৩ লাখ ১৫৫ মিলিমিটার গোলা ইউক্রেনে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটিও একই রকমভাবে বাজে সিদ্ধান্ত।
ঘনিষ্ঠ মিত্র উত্তর কোরিয়া ও ইরানের কাছ থেকেও রাশিয়া সহযোগিতা পাচ্ছে। দুটি দেশই ১৫২ মিলিমিটার (প্রকৃতপক্ষে ১৫২ দশমিক ৪ মিলিমিটার) গোলা উৎপাদন করে। প্রকৃতপক্ষে ইরান ও উত্তর কোরিয়া—দুই দেশ মিলে রাশিয়াকে কতগুলো গোলা সরবরাহ করছে, সেটা জানা কঠিন। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া এরই মধ্যে পাঁচ লাখ গোলা পাঠিয়েছে। মোট ২০ লাখ গোলা পাঠানোর প্রস্তুতি তারা নিয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের কাছ থেকে পাওয়া গোলা মজুত করে রেখেছে রাশিয়া। হতে পারে, আপৎকালে ব্যবহারের জন্য অথবা ইউক্রেনে বড় ধরনের আক্রমণ অভিযানের জন্য রাশিয়া সেগুলো মজুত করে রেখেছে।
ইউরোপীয়রা বলছেন, ইউক্রেনে পাঠানো গোলাবারুদ ফিরিয়ে আনা দরকার। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ নেই। রাইনমেটালের মতো ইউরোপের কয়েকটি অস্ত্র কোম্পানি নিজেদের উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বাড়তি সেই গোলাবারুদ পেতে আরও কয়েক বছর লেগে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি গোলাবারুদ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি কারখানা আইওয়া ও পেনসিলভানিয়ায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলোর পক্ষে উৎপাদন বাড়ানো খুবই কঠিন। কারণ হলো, তারা পুরোনো উৎপাদনপদ্ধতি ব্যবহার করে। আর কাজের পরিবেশ কঠোর হওয়ার কারণে অনেকেই সেখানে কাজ করতে চান না। যুক্তরাষ্ট্রের এই কারখানাগুলো ৮০ বছরের বেশি পুরোনো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২৮ সালের মধ্যে প্রতি মাসে ১৫৫ মিলিমিটার গোলা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে ৮০ হাজার করতে চায়। আর ইউরোপীয়রা ভবিষ্যতে প্রতি মাসে ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার ১৫৫ মিলিমিটার গোলা উৎপাদন করতে চায়।
ন্যাটো এই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু ইউরোপে যদি কোনোভাবে আরও বড় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে কিংবা কোরিয়া উপদ্বীপ, চীন, তাইওয়ান, ইসরায়েলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এ সংখ্যা জানালা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার হবে।
ইউক্রেন পর্যন্ত ন্যাটোর সম্প্রসারণ করা হলে জোটটির সঙ্গী দেশগুলোর জন্য ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে ফেলবে। এটা ন্যাটোর প্রতিরক্ষার ক্ষমতা কমিয়ে দেবে। পরিষ্কারভাবে সেই সুযোগ নেবে চীন ও রাশিয়া।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত